Skip to main content

ষাঁড়টা বুড়ো হয়েছে। গোটা শরীরটা বুড়ো হয়েছে। তার স্বপ্ন ভেঙে গেছে, কিম্বা স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আছে, সে সব কিছু না। সে আর স্বপ্নই দেখে না। এখন ষাঁড় আর স্বপ্ন বললেই ধাক্কা লাগবে, ষাঁড়ের আবার স্বপ্ন হয় নাকি? হয়। কিন্তু যদি বলতাম পাখিটার একটা স্বপ্ন ছিল, কিম্বা প্রজাপতিটার একটা স্বপ্ন ছিল….. ধাক্কা লাগত না। ষাঁড় বললাম বলে লাগল ধাক্কাটা লাগল। কিন্তু ষাঁড়ও স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এই ষাঁড়টা আর দেখে না।

দুপুরবেলা। রোদের তাপ বেশ। ভোজবাড়ির কিছু ফেলে দেওয়া ভাত, এটাসেটা খেয়ে সে রাস্তার ধারে বসে আছে। চোখটায় ঝিমুনি লেগে আসছে। কয়েকটা গরু দূরে দূরে ঘাস খাচ্ছে। আগে তাকে সমীহ করে চলত। এখন একবার তাকালেই নিজেকে ধন্য মনে করে। তাও তাকানোর যা ছিরি…. মরেনি এখনও… এই যেন বলতে চায়।

=====

হীরু পালের অবস্থাও ষাঁড়টার মত খানিকটা। তবে পার্থক্য হল, হীরু পালের স্বপ্ন না জন্মালেও, এই বয়সেও দুর্বুদ্ধিগুলো মাথায় এখনও টিস টিস করে। সংসারে পছন্দ কেউ করার নেই। ছেলেটা ভালো, তাই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে না। যদিও বার করে দেওয়ার কারণ আছে অনেক। সে হীরুর ছেলের চাইতে হীরুই বেশি জানে।

হীরুর গাঁজার নেশা। নেশা চড়িয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে ষাঁড়ের সামনে এসে পড়ল। ভক্তিভরে দুটো প্রণাম করে, থেবড়ে বসেই বলল, তোমার শরণেই নাও বাবা!

আগের দিন হলে কাছে ঘেঁষতে পারত? শালা বয়েস হচ্ছে বলেও তুইও…..

যা হোক, মদন, মানে ষাঁড়টা দুবার হাই তুলে হীরুর দিকে তাকালো।

হীরুর চোখ লাল। মুখের একদিক থেকে লালা ঝরছে। দাঁত হয় তো মেরেকেটে চারটে কি পাঁচটা। রোগা শরীরটা দেখলে মনে হয় আঁখ দিয়ে বানিয়েছে। মদন ইচ্ছা করেই হীরুর ঘাড়ের নীচে একটা লেজের বাড়ি দিল।

হীরু তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলল, সরে বসব বাবা? অসুবিধা হচ্ছে?

মদন দেখল দূর থেকে বাতাসে ভেসে ভেসে দুজন যেন আসছে।

=====

কালো কাপড় জড়ানো দুজন অদ্ভুত প্রাণী এসে দাঁড়ালো। পা মাটিতে ঠেকছে না। আবার উড়েও যাচ্ছে না। হাত পা মাথা নেই…. আবার যেন আছেও। হঠাৎ বলে উঠল একজন, তোমাদের যেতে হবে…. আমরা যমদূত…  আজ তোমাদের ডেলিভারি দিয়েই আমাদের কাজ শেষ। এসো তো বাছারা!

মদনের প্রাণে মনে কোনো স্বপ্ন নেই। কিন্তু আচমকা সামনেই যমদূতকে দেখে মনটা কেমন কেঁদে উঠল, অনেক দিনের বস্তা ঝাড়লে যেমন জন্মের ধুলো বেরোয়, তেমন করে হঠাৎ গ্রামের বটগাছটার জন্য, বাজ পড়া তালগাছটার জন্য, পীরিচের মায়ের জন্য মনটা কেঁদে উঠল। পীরিচের মা খুব আদর করে খাওয়াতো মদনকে। এখন ছেলেই খেতে দেয় না, তাকে আর কি খাওয়াবে। তাও পক্ষাঘাতে বিছানায় পড়ে আছে। ওকে সঙ্গে নিলে হয় না?

না হয় না। ওর খাতা ফুরাতে দেরি আছে। যমদূতের একজন বলল।

তার মানে এরা মনের কথা পড়তে পারে। ওদিকে হীরু পালের সঙ্গে এক যমদূতের কি নিয়ে বচসা বেধেছে। সে নাকি বাড়ির গাছের কাঁঠালের একটা কোয়া না খেয়ে মরবে না। কিছুতেই না। হীরু কাঁদছে। বদলোক প্রাণখুলে কাঁদতেও পারে না। হীরুও পারছে না। আসলে প্রাণ সরল না হলে কান্না আসে না। হুতাশ আসে। হুতাশে চোখের জল শুকিয়ে যায়, কোঁৎ পাড়াটাই থাকে। হীরু কোঁৎ পাড়ছে।

======

দুই যমদূত কিতকিত খেলছে। তাদের দু ঘন্টা সময় দিয়েছে। এর মধ্যেই মন তৈরি করে ফেলতে হবে। শরীর থেকে আত্মার গাঁট খুলতে নাকি পনেরো মিনিটের বেশি সময় লাগে না। মন তৈরি হলে শুকনো আত্মা বেরোয়, নইলে চ্যাটচেটে আত্মা। সময় লাগে। ঝঞ্ঝাটও অনেক।

হীরু মাঠে শুয়ে আছে উপুড় হয়ে। কাঁদছে না। শূন্য দৃষ্টিতে মাটিতে শুয়ে তাকিয়ে। কি সব বলে যাচ্ছে বিড়বিড় করে। মাথাটার ভিতরে যেন কিছু কামড়াচ্ছে। মাঝে মাঝেই মাথাটা মাটিতে ঠুকে বলছে, যাহ্, যাহ্। হাত দুটোর দশটা আঙুল মাটি কামড়ে ধরে আছে।

মদনের মনটা আবার কখন জানি শান্ত হয়ে গেছে। যেতে তো হতই। কিন্তু এতবড় জীবনটায় কি করল? কিচ্ছু মনে পড়ছে না। জীবন বলতে শুধু গতকালের সকাল থেকে কিছু ঘটনা মনে আসছে। জোর করে ভাবলে বাকি এলোমেলো কিছু তুচ্ছ ঘটনা মনে আসছে। খুব একটা রাগ, ক্ষোভ, আনন্দ, উল্লাস, ব্যথা, শোক কিছুই হচ্ছে না তো। গোটা জীবনটা ক'ঘন্টা ছিল? যেন দুটো দিনের বেশি কিছুই ছিল না। কেউ-ই কোনোদিন নিজের ছিল না। নিজেও নিজের ছিল না। তবু এখন মনে হচ্ছে সবাই নিজের ছিল। দূর থেকে দেখলে সবাইকে কেমন নিজের লাগে। নিজেকেও।

পীরিচের মা একবার বলেছিল। কাশী যাচ্ছিল, পাড়ার কিছু বাড়ির সঙ্গে। রাতে মদন দেখা করতে গিয়েছিল। পীরিচের মা কলাবাগানে বসে বসে, কচি কলাপাতা নিজের হাতে কেটে কেটে খাওয়াতে খাওয়াতে তাকে বলেছিল, সংসারটাকে আলগা করে দেখিস যদি মদন তবে সবাইকে বেশ নিজের লাগে। কিন্তু জোরে চেপে ধরিস যদি, তাতে খালি হাতের ছাপ লেগে যায়, জিনিসটা তুবড়ে যায়, খানিকবাদে হাতও ব্যথা করে, আঙুলগুলো টাটায়।

মদন বলল, আমি তৈরি। শুধু একবার পীরিচের মাকে দেখে যাব, যাওয়ার রাস্তায়…. হবে?

দুজন যমদূত নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চায়ি করল। বলল, হবে।

হীরুর মুখ দিয়ে গাঁজা বেরোচ্ছে। হীরুর দশটা আঙুল মাটির গভীরে ঢুকে। সে কাতরাচ্ছে আর বলছে, জল… জল… জল।

জল দেওয়ার কেউ নেই। একজন যমদূত মদনকে বলল, তুই দে…. ছেড়ে দে জল… পেট ফাঁকা কর.. ও এমনিতেও বেরোতোই…..

======

চারজনে হাওয়ার ভাসতে ভাসতে পীরিচের মায়ের বাড়ি এলো। পীরিচের মা খাটালের পাশের ঘরে শুয়ে। সারা পিঠ ঘা। শরীরটা মনে হচ্ছে ঝাঁটার কাঠি দিয়ে আটকানো। দরজার সামনে পীরিচের বাচ্চা ছেলে বল নিয়ে খেলছে। পীরিচের ঠাকুমা হাঁ করে তাকিয়ে। চোখ দুটো দিয়ে বাচ্চাটার সারাটা গা যেন চেটে দিচ্ছে। পীরিচের মা যেন গরু।

মদন বলল, আমি আসি।   

পীরিচের মা খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, আয় আয়। বাগান থেকে দুটো কলাপাতা খেয়ে যাস।

হীরু বলল, শালা আমার মুখে মুতে দিয়েছে…..

পীরিচের মা বলল, বেশ করেছে। যাওয়ার আগে ওই কুলুঙ্গিতে রাখা দুটো সুপারি নিয়ে যা। আর তোমরা, যমদূত বাবারা, হাতে করে দুটো বাতাসা নিয়ে যাও না বাবারা…. প্রভুকে দিও… বোলো পীরিচের মায়ের কোনো তাড়া নেই…. সে সুখেই আছে।

হীরুর চোখে জল এলো। হীরুর এমন হয় না। বুকের থেকে ব্যথা উঠে গলা পুড়িয়ে সোজা চোখে জল আনেনি কোনোদিন। বুকের সব কিছুকেই শাসন করত চিন্তা। মাথা থেকে নেমে এসে ফিসফিস করে বলত হীরু… দুর্বল হোসনি… দুর্বল হোসনি….

আজ হীরুকে কেউ বলল না। হীরু কাঁদছে। পীরিচের মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে, ভালো হয়ে যাও…. সব পাপ তোমার আমাতে আসুক…. এমনিতেই আমার যা জমেছে…. ওতে কিচ্ছু হবে না….

পীরিচের মা হীরুর থুতনিতে হাত দিয়ে চুমু দিয়ে বলল, বালাইষাট! ওটুকু পাপেতেই তো আমার সুখ ছিল। তোকে তাই দেব কেন রে মুখপোড়া…. প্রভু তো বাতাসা পেলেই খুশী…. আর সে মীনসে তো আমাকে না পেলে পাগল হত….. সে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে… নরকে না হোক স্বগ্গে…

কে গো, তোমার বর? হীরু জিজ্ঞাসা করল।

পীরিচের মা হেসে বলল, ধুর মুখপোড়া….

মদনের মাথায় হঠাৎ এতদিন পর একটা স্বপ্ন জেগে উঠল। কি সেটা স্পষ্ট বুঝল না। কিন্তু কিছু একটা বুঝল। অল্প আফসোস হল। স্বপ্নটা যেন কেন্নোর মত শিউলির ডালের মগডালে উঠে, আর কোনো ডাল না পেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। কে যেন বলে উঠল, উফ!

কে?