মানসিকভাবে ভালো থাকাটা একটা সাধনা। বাহ্যিকভাবে ভালো থাকার জন্য বাইরে থেকে কিছু জোগাড় যন্ত্র করে নিলে মিটে যায়। যাকে কম্ফোর্ট বলে। কিন্তু মানসিকভাবে ভালো থাকাটা ওভাবে হয় না। তাকে সাধনার মত করে তিলে তিলে গড়ে তুলতে হয়। কেন?
কারণ মনের একটা অসুখী হওয়ার প্রবণতা আছে। আশেপাশের অ-সুখকে নিজের মধ্যে ইমবাইব করার একটা ঝোঁক আছে। কেন আছে, সে কথাটা বড় নয়, মনের যে এ প্রবণতা আছে সে স্বতপ্রমাণ। প্রত্যেকেরই নিজের অভিজ্ঞতা কমবেশি আছে। তাই মনকে ভালো রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। আয়রনি হচ্ছে সেটাই সব চাইতে অবহেলিত একটা কাজ।
মন মানে কি? চিন্তা। চিন্তার সঙ্গে জড়িয়ে অনুভব, অভ্যাস। মন একটা অভ্যাস। তার কিছুটা আমার হাতে, কিছুটা তার নিজের। তবে অনেকটাই তো আমার হাতে। মনকে ভালো রাখতে হবে। ভালো রাখতে হবে মানে আপাতভাবে দুটো হয়। এক সুখী রাখতে হবে। দুই, সুস্থ রাখতে হবে।
মনকে সুখী রাখাটা একটা ইউটোপিয়া। ও হয় না। মন দু:খী হবেই। কিন্তু মনকে ভালো রাখাটা একটা দায়িত্ব। যেমন শরীর অসুস্থ হলে শরীরের যত্ন নেওয়া, এও তেমন। শুধু এটা বুঝে নিতে হবে এ কাজটা অনেক যত্ন দাবী করে আমার কাছে। এখানে আমি যদি ফাঁকি দিই, তবে সেই ফাঁকে অবশেষে আমাকেই পড়তে হবে। কিন্তু কিভাবে ভালো রাখা যাবে?
এখানে অন্যের মতের, অন্যের বিশ্বাসের, অন্যের কোনো কিছুরই কোনো দাম নেই। অনেক অনেক বই লেখা হচ্ছে, সোশ্যালমিডিয়া থেকে শুরু করে খবরের কাগজ রোজ নিত্য নতুন টিপস এ ভরে যাচ্ছে। নানাবিধ কৌশলের পর কৌশল, রহস্যের পর রহস্যের মত করে জানানো হচ্ছে। রীতিমতো একটা দারুণ ব্যবসার পন্থা এটা এখন। আমাদের তথাকথিত ধর্মগুরুরাও বাদ নেই।
কিন্তু আসল কথাটা হচ্ছে মনকে ভালো রাখার এমন কোনো কৌশল, কোনো উপায়, কোনো মন্ত্র-গুপ্তবিদ্যা নেই যা রাতারাতি ফল দেবে। এ সাধনা। ধীরে ধীরে হবে যা হবে। কিন্তু প্রতিদিন নিজেকে দিয়ে নিজেকে এটুকু স্বীকার করাতে হবে যে আমার নিজের মনের উপর দায়িত্ব আছে নিজেকে ভালো রাখার।
কি করা যায়? এই হল সেই প্রাচীন প্রশ্ন। ইতিমধ্যে গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গেছে, কিন্তু উত্তর একটাই আছে। মনকে ভালো রাখা একটা সাধনা। আর সেই সাধনা হল নিজেকে জানা, নিজেকে বোঝা ধীরে ধীরে।
এখানেও একটা আয়রনি আছে। আমাদের প্রাথমিক বিশ্বাস আমরা সবাই নিজেকে বুঝি। কিন্তু সংকটকালে নিজের আচরণ দেখে বুঝি নিজেকে কাঁচকলা বুঝি। নিজের উপর রাগ, হতাশা, ক্ষোভ ইত্যাদি যাই হোক না কেন, রাস্তা আমাকেই বার করতে হবে। আমার হয়ে কেউ-ই আমাকে বুঝে দেবে না। আমি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যাই, প্রচুর অর্থের বিনিময়েও এই একটি জিনিস আমি কোনোদিনই সেকেন্ড হ্যাণ্ড জানতে পারব না, আমি নিজে কি।
এর জন্য চাই প্রচুর ধৈর্য আর নিজের জন্য বানানো নিজের একটা সৎ ডেটাবেস। যখনই যা ঘটুক, আমি যে কোনো সম্পর্কে, পরিস্থিতিতে যা-ই আচরণ করি, তা নোট রাখার ডেটাবেস। তাকে বিন্দুমাত্র ম্যানিপুলেট না করে জাজমেন্টাল হয়ে বা নানাবিধ ওপিনিয়নের সঙ্গে, ডায়াগনসিসের সঙ্গে নিষ্ঠুর তুলনা করে।
অবশ্যই এ দীর্ঘদিনের কাজ। কিন্তু আর তো কোনো পথই নেই। কোনো ম্যাজিক, কোনো আলাদীনের প্রদীপ, কিচ্ছু নেই। অত্যন্ত ভাবগম্ভীর ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে নানাবিধ টিপস তো মাত্র কয়েকদিনের জন্য কিছু একটা হচ্ছে টাইপের মনে হবে। তারপর? আবার সে-ই অন্ধকার। উপায় একটাই, আমার নিজের বানানো ডেটাবেস।
সেকি খাতায় টুকে রাখার? না। সে নিজের সঙ্গে নিজের প্লেজেন্ট-আনপ্লেজেন্ট পরিচয়ের দীর্ঘপথ। প্রতিটা জানাই অল্প অল্প করে আমাকে আমার কাছে আনবে। আমাকে কিচ্ছু কোথাও টুকে রাখতে হবে না, মুখস্থ রাখতে হবে না। শুধু এইভাবে দিনে দিনে নিজের মুখোমুখি হতে হবে। নিজের সঙ্গে নিজের আপনিই বোঝাপড়া হবে।
তত্ত্বটা হল, আসলে আমরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের মত করে ভীষণভাবে কণ্ডিনশণ্ড। আমরা কেউ-ই মুক্ত নই। নিজের নিজের কণ্ডিশনগুলোকে চেনাটাই সাধনা। নিজেকে ভালো রাখার এই একমাত্র রাস্তা। এ দায়িত্ব কি আমার হয়ে অন্য কেউ নিতে পারে?
(ছবি আন্তর্জাল)