সে থামালে থামি আবার.... সে বাজালে বাজি.....
কে থামায়? কে চালায় গোঁসাই?
সকালবেলা। তারাপীঠ শ্মশানে বাউল বসেছে। আলো করে। সকালের আলোর চেয়ে তার আলো মিঠে। একতারায় টুং টাং আওয়াজ উঠছে। শ্মশানেও এত পাখি ডাকে? পাখির ডাকের আওয়াজে একতারার তার মিশছে। ধাতু কোথায়? এ তো হৃদয়। এ তো রক্ত। এ তো শ্বাসপ্রশ্বাস। যে আসছে দাহ হতে, সে কই? আসছে তো শরীর। সে কই? তাকে কোনোদিন কেউ দেখেছে? সংসার তার হাঁটাচলায়, কথাবার্তায় ঠাহর করেছে - এ অমুক, সে তমুক। আসল মানুষটা কই? সে তো অধরা। নিজের কাছেও, সংসারের কাছেও। তাকে কী দাহ করা যায়?
একজন ঝাঁট দিচ্ছে। এক যুবক। ঝাঁট দিতে দিতে থামল। হাফপ্যাণ্টের পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করল। এগিয়ে এসে হাঁটু মুড়ে বসল বাউলের সামনে। বাউল তার গলার আওয়াজ শুনে হাত বাড়ালো, বিড়িটা হাতে নিয়ে ঠোঁটে জাপটে ধরল। দেওয়া নেওয়ায় কোনো আড়ম্বর নেই। হিসাবকিতাব নেই। চাওয়া পাওয়া নেই। সে ছেলে আগুন ধরালো বাউলের বিড়িতে। নিজেও ধরালো। বাউল তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল, কাল অমুক অত ঝামেলা করছিল কেন রে?.... ছেলেটা বলল, মাল খেয়েছিল….তারপর সাধুদের সঙ্গে ক্যাঁচাল।
বাউল উদাস হল। কেন যে ওদের সঙ্গে লাগতে যায়…..
ছেলেটা আবার ঝাঁটা টানছে। খস খস খস। একজন বাবু এসে বসল। “বাবা কথা আছে….”
বাউল গলার স্বরে মানুষের হৃদয়ের অবস্থান বোঝে। এ একান্ত চায়। ব্যথা আছে কিছু।
“ছেলেটা মানুষ হল না বাবা। এত টাকা আমার। এত বৈভব। কাকে দেব? কে সামলাবে? বিশ্বমাতাল হয়েছে। দিনরাতের হুঁশ থাকে না ওর। সব উড়িয়ে দিচ্ছে। ওর মা চলে যাওয়ার পর….”
গলা ধরে এলো। পেছনে ঘন্টা নেড়ে পুজো দিচ্ছে এক অল্প বয়েসী অবাঙালি মহিলা। উবু হয় বসে এক হাতে ফুল দিচ্ছে, এক হাতে ঘন্টা নাড়ছে। ফুলের পর প্রদীপ। প্রদীপের পর ধূপ। কে চায় এতকিছু? নাকি তোমার দিয়ে সুখ? কী পাও?
ক্ষুব্ধ, শোকতপ্ত বাবার চোখে জল। কোকিল ডাকল। শ্মশানে কোকিল ডাকে বাবা?
বাউল চুপ করে বসে। একটু পর বলল, মাকে ডাকো বাবা…এর বেশি কী বলি….
কিন্তু আমরা তো এর থেকে অনেক বেশি চাই বাউল। তার থেকেও অনেক অনেক বেশি। আমার সান্ত্বনাও চাই অফুরান। নিজের বলতে কিছু নেই সংসারে। আমার শান্তি নেই। নিত্যনতুন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার উদযাপনই জীবন।
“মন কেন মায়ের চরণছাড়া…” বাউলের মিঠে গলা।
আমাকে নিয়ে আমার অনেক আশা বাউল। ক'টা পূরণ হল তার? আমার দিন কাটে ঈর্ষার বিষফোঁড়ায় জ্বলে জ্বলে। আমার মনটা মেলে দেখাই যদি বাবা সহ্য করতে পারবে না….. নাকি তুমিই একা সহ্য করতে পারবে….. এত শোক… এত ভয়….. হারিয়ে যাচ্ছি বাউল….
কেন বাবা, রামকৃষ্ণদেবের কথা শোনোনি? মাকে ধরে থাকো….. বুড়ি ছুঁয়ে থাকা….
মাকে ধরে থাকা কী বাউল?
মা যে ধরে আছেন এটা বোঝা…. নিজের উপর ভরসা গেলে মায়ের উপর ভরসা আসবে…..
নিজের উপর ভরসা তো নেই আর বাউল…. তাই এত বিষাদ… নিজেকে রেসের ঘোড়ার মত ছুটিয়েছি…. আঁখের মত ছিবড়া করে সব রস শুষে নিতে চাইছি জীবন থেকে….. রস নেই বাউল এখন…. সব ছিবড়া……
এবার ফেরো….. মায়ের দিকে ফেরো… মায়ের দিকে ফিরবে বলেই তো এত আয়োজন….
বাউল বসে থাকল একা। আবার লোকের সঙ্গে। আবার একা। কোকিল থেমে গেল। সকালের রোদ রুক্ষ দুপুরের রোদ হল। বাউল উঠল। বাউলের ছায়া পড়ে না মাটিতে। বাউল এগোয়। সব কথা, সব শোক মাটিতে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে থাকে। মানুষের সঙ্গে কী যায়?
বাউল গাইছে.... "ব্রহ্মমুহূর্তে গাও ব্রহ্মময়ীর নাম রে...."