বাসের পিছনের জানলার ধারের সিটটা রহিমের ভীষণ প্রিয়। জাগুলী থেকে শিলিগুড়ি তাকে আর না হোক মাসে চারবার যেতে হয়। বাসেই যায়। কদাচিৎ ট্রেনে। ট্র্যাভেলারের সাথে তার ভালোই দোস্তি। এই সিটটা ফোন করলেই ফাঁকা রেখে দেয় শিবু, মানে যাদের ট্র্যাভেলস আর কি।
কিন্তু আজ যে ভয়টা পাচ্ছিল সেটাই হল, শিবুকে ফোন করার টাইম পায়নি। বাসে উঠে দেখে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক শেষ জানলার সিটটায় বসে। তার পাশেরটা তার। মনটা একটু তিরকুটে হল। তবু যাক, একটু একটু ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে, সেদিক থেকে ভালোই হল।
- কই যাবে?
বয়স্ক ভদ্রলোকই প্রশ্ন করলেন। পান খাওয়া দাঁত। খোঁচাখোঁচা দাড়ি। কাঁচাপাকা গোঁফ। মাথায় উলের টুপি। পোশাক বলতে খদ্দরের পাঞ্জাবী আর প্যান্ট।
- শিলিগুড়ি
- অ...
কথা বাড়াতে ইচ্ছা করল না রহিমের। মেজাজটা ফের ধষ্টালো। ধুস্, এভাবে যাওয়া যায়। সে চোখ বুজে ক্লান্তির ভান করল। কথা এড়াতে চায়।
বাস চলছে আধঘন্টা হল। কৃষ্ণনগরে খাওয়ার জন্য থামল। রহিমের চেনা দোকান। রুটি আর তড়কা হেব্বি বানায়। সেই খেয়ে সকালের জন্য একটা কেক কিনে উঠে দেখে ভদ্রলোক ঘুমাচ্ছেন। সেকি, খাবে না লোকটা? নাকি টের পায়নি কৃষ্ণনগর এসে গেছে। রহিম এগিয়ে গিয়ে ডাকল, দাদা... দাদা... খেতে যাবেন না?
সাড়া দিচ্ছেন না। গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেই ভদ্রলোক চোখ মেলে তাকালেন।
- খেতে যাবেন না?
মাথা নেড়ে হাসলেন। আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। বাস ছাড়ল। খুব ইমারজেন্সি না হলে মালদার আগে আর দাঁড়াবে না। হুসহুস করে ছুটছে বিদ্যুৎ ট্র্যাভেলারের বাস। আলো নেভানো। বেশিরভাগ যাত্রী ঘুমিয়ে। কেউ কেউ ফোন নিয়ে খুটুরখুটুর করছে।
রহিমের চোখ লেগে আসছে। তার দোকানের মালিকের মুখ মনে পড়ছে.. কাপড়জামার ডাঁই চোখে ভাসছে... কিছু মহিলা খদ্দেরের মুখ আসছে... রাণাঘাটে তাদের বাড়ির কুয়োপাড় মনে আসছে... কুয়োপাড়ে কে বসে ওটা? মুখটা চেনা চেনা না? কাছে এগোচ্ছে... এগোচ্ছে... আরে পাশে বসা বুড়োটা না? চমকে চোখ মেলল। বাইরেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। পাশে বুড়োটা বসে। এক ঝলকা স্ট্রিট লাইটের আলোয় মনে হল বুড়োটা তার দিকে তাকিয়ে আছে বিস্ফারিত চোখে। হ্যাঁ ঠিক, পরের আলোর ঝলক পড়তেই দেখল তাই। সে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল এক ঝটকায়। কিন্তু একি! এগোতে পারছে না যে, পা’টা অসাড় হয়ে গেছে তার। সবাই ঘুমাচ্ছে। কাউকে ডাকতে হবে তো! কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ। চাইলেই চিঁ চিঁ-র বেশি শব্দ হল না, যা অনায়াসেই বাসের আওয়াজে চাপা পড়ে গেল।
হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা কিছু একটা তার হাত ধরল, বুড়োটার হাত, বরফের মত ঠাণ্ডা! তাকে টেনে তার পাশে বসাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে হল বুড়োটার মুখটা যেন সে এই অন্ধকারেও বুঝতে পারছে। বিস্ফারিত দুটো চোখ, যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে এখনি, তার দিকে অপলক তাকিয়ে।
রহিম বসে পড়ল। তার মুখটা সামনের মানুষটার মুখের কাছে। রহিম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তাকে। কিন্তু কিভাবে দেখছে সে জানে না। সে বেশ বুঝতে পারছে বুড়োটা শ্বাস নিচ্ছে না। ক্রমশঃ একটা বড় ‘হাঁ’ করল বুড়োটা। মুখের ভিতর থেকে কয়েক দলা মাটি আর কয়েকটা কেঁচো তার কোলের উপর পড়ল। একটা বড় মাকড়সা ফড়ফড় করে বেরিয়ে বুড়োটার একটা চোখের উপর দাঁড়াল। রহিম পাথরের মত শক্ত। সব বুঝছে, কিন্তু নড়াচড়ার শক্তি নেই তার। বুড়োটার একটা হাত তার হাত ধরা এখনও। বাস ছুটছে। সে বুঝতে পারছে। তার সামনের সিটের লোকটা কাশল, উঠল, জল খেলো, আবার শুলো। রহিম কিচ্ছু করতে পারছে না।
কুয়োপাড়ের একদিকে বুড়োটা বসে উবু হয়ে। আরেকদিকে রহিম। জল তুলছে। হঠাৎ হাত পিছলিয়ে বালতিটা নীচে পড়তে লাগল। দড়িটা তাকেও হ্যাঁচকা টান মারল, সে উপুড় হয়ে কুয়োর মধ্যে ঝুঁকে পড়ল, পিছন থেকে ঠাণ্ডা দুটো হাত তার পিঠে ধাক্কা দিয়ে কুয়োয় ঠেলে দিল। সে পড়ছে। গভীর অন্ধকার। পাশে ওগুলো কি? রাণাঘাটের তাদের বাড়ির পিছনের মাঠের গোরস্থান। সব কবরের উপরের মাটিগুলো সরানো। সবার মাথাগুলো বাইরে, গলা থেকে মাটি চাপা কবরের নীচে। ওই তো ফিরদৌস, সাকেত, ফরজানা, তার আব্বার বন্ধু - নাম মনে নেই... তার মুখটা যেন মাটির মধ্যে চেপে ধরছে কে, সে শ্বাস নিতে পারছে না... দমবন্ধ হয়ে আসছে... হঠাৎ মাথায় বাড়ি লাগল শক্ত কিছুর....
জ্ঞান ফিরল মালদার হাস্পাতালে। বাস অ্যাক্সিডেন্ট কেস। ডান হাতটা ভেঙেছে। মাথায় মোটামুটি একটা আঘাত। ডাক্তার বলেছে ভয়ের কিছু নেই। তবে তার মুখের মধ্যে একদলা মাটি পাওয়া গিয়েছিল। ডাক্তারদের অনুমান দুর্ঘটনার পরে মাটিতে পড়েই হয়ত।
ড্রাইভারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। দশদিন পর মেলে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায়। সে বলছিল একটা বুড়োলোক, একমুখ মাটি, তার বাসটাকে টেনে কুয়োয় নিয়ে যাচ্ছিল, স্টিয়ারিং নাড়াতে দিচ্ছিল না। তার বেশ কিছুদিন পর তার মৃতদেহ তাদের বাড়ির কুয়োতে পাওয়া যায়। পুলিশের অনুমান অ্যাক্সিডেন্টের জন্য মাথায় শক পেয়ে এই অবস্থা।
এই ঘটনার বছর চারেক পর। রহিম বাসে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সন্ধ্যে সাতটা, শিয়ালদহতে দাঁড়িয়ে, উত্তরবঙ্গ ধরবে। স্লিপার ক্লাস, আপার বার্থ। খেয়েই উঠেছে। ন’টা নাগাদ শুয়ে পড়ল কম্বলমুড়ি দিয়ে। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পড়েছে। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। দরদর করে ঘামছে। সেই স্বপ্নটা আবার দেখল.. সেই কুয়ো.. সেই গোরস্তান..
নামল আপারবার্থ থেকে। জল খেল। ঘড়ি দেখল। মালদা ঢুকবে খানিক পর। টয়লেট গেল। ভালো করে ঘাড়েমুখে জল দিয়ে আয়নার সামনে মুখ মুছতে গিয়ে তার শিরদাঁড়া দিয়ে হিমের স্রোত বয়ে গেল। সেই লোকটা তার পিছনেই দাঁড়িয়ে...