একদিন লিখেছিলেন, "যাবার আগে জানি যেন/ আমায় ডেকেছিল কেন/ আকাশ পানে নয়ন তুলে শ্যামল বসুমতি/ কেন নিশার নীরবতা শুনিয়েছিল তারার কথা/ পরাণে ঢেউ তুলেছিল কেন দিনের জ্যোতি/ তোমার কাছে আমার এ মিনতি, এ মিনতি।"
জানা হয়নি। শেষের ক'দিন মাত্র আগে লিখে গেলেন,
প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে,
কে তুমি—
মেলে নি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে ,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়,
কে তুমি—
পেল না উত্তর।
কেউ উত্তর পায় না। সাজানো উত্তরগুলো শুকিয়ে যায়। ঈশ্বর বালুতটে আঁকা ছবির মত আকার হারিয়ে অসীম তখন। অসীম তো বোধের বিস্ময়। হৃদয় তো নীড় পিয়াসী। কম্পিত বোধ আসন্ন অন্তিম মুহূর্তের অপেক্ষায়। সব শূন্য সামনে। "ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।" কোথায় কর্ণধার? সে তো ছলনাময়ী তখন, শেষ লেখা কবিতায়।
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা-জালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জল।
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।
এক এক সময় ভাবি, কি ভীষণ প্রহেলিকা, কি ভীষণ প্রহসন সবটুকু জীবন জুড়ে। এ বিষাদের কথা নয়। এই ভবিতব্য। এই পরিণতি। যেটুকু মুহূর্ত পরিপূর্ণতার বোধ নিয়ে আসে জীবনে সেইটুকু মুহুর্তই সব। সেই মুহুর্তের কোনো দাবী নেই। কোনো ক্ষোভ নেই। তার আসা যাওয়ার কোনো কারণও নেই, নিয়মও নেই।
বাকি যত বোধের পরিধি বড়, ততই গভীর শূন্যতার বোধ। সুখ যেন গভীর রাতের অন্ধকারে উড়ে যাওয়া কোনো সুদূর আকাশে পাখির ডানার শব্দ। কল্পনায় সে ডানার হাওয়ার আঘাত। ক্ষণিকের জন্য। তারপর আবার অপেক্ষা। অদেখা পাখির ডানার শব্দের অপেক্ষা।
তবু এ বিষাদ নয়। বঞ্চনা নয়। অপূর্ণতা নয়। ক্ষোভ নয়। এ জীবন। সবটুকু নিয়েই জীবন। মানবিক অর্থহীন অস্তিত্ব। অব্যক্ত অনুভব। যন্ত্রণাটুকুর অর্থ খুঁজতে যাওয়া অকারণ। যন্ত্রণাটুকুই সত্য। শান্তি।