Skip to main content

 সবাই সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছে। সবাই সবাইকে আড়চোখে দেখে - জীবনানন্দ লিখেছিলেন। মুখ খুললেই নিন্দা, অসহিষ্ণুতা। রাতদিন কান চোখ ঝালাপালা।

       সেদিনের গল্প। ১৯১২ সাল। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লণ্ডনে রীতিমতো সাড়া পড়ে গিয়েছে। কেউ বলছেন নাটকে গ্রীকের রস। কেউ বলছেন কবিতায় কেম্পিসের 'ইমিটেশান অব ক্রাইস্ট' এর ছায়া। কেউ উপনিষদের বাণী শুনতে চার্চে ডাকছেন। কেউ বলছেন এদ্দিন বাদে একজন কাউকে শুনলাম, যিনি সত্য অর্থে কবি।

       আর ভারতে, কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনিন্দা মুখর হয়ে স্টার থিয়েটারে নাটক নামাচ্ছেন। কবিকে পাওয়া যাচ্ছে না হাতের মুঠোয়। কবির ভাবমূর্তিকে ব্যঙ্গের কুঠারে ছিন্নভিন্ন করে, তুচ্ছতাচ্ছিল্যর কালিমায় মাখামাখি করে একটা কিছু করতেই হবে, এমন পণ।

       রবীন্দ্রনাথের কাছে খবর গেল। তিনি চারুচন্দ্র মহাশয়কে চিঠিতে লিখছেন,

 

"দ্বিজেন্দ্রবাবুর জন্য আমি সত্যই দুঃখ বোধ করি। আমি এ দেশে খ্যাতি লাভ করব কল্পনাও করিনি, সেজন্য অগ্রসর হয়ে আসি নি - দৈবক্রমে জুটে গিয়েছে। এই খ্যাতির সর্বপ্রধান সুখ এই যে এতে করে আমার দেশের লোকের মনে আনন্দ হবে- এ আমার একলার জিনিস নয়। কিন্তু এক জায়গায় দুঃখ উৎপন্ন হচ্ছে সে আমারও দুঃখ।...দ্বিজেন্দ্রবাবুর প্রতিভা কি তাঁর একলার সামগ্রী? তিনি যেখানে মহৎ সেখানে সে মহত্ত্ব আমাদের সকলেরই, কিন্তু যেখানে তিনি ক্ষুদ্র, সেখানেই তিনি স্বতন্ত্র।...চাঁদের জ্যোৎস্না সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু তার কলঙ্ক তার নিজের বুকেই দাগা থাকে। আমার কবিতার মধ্যে অযোগ্য জিনিস ঢের আছে - আমার বাঁশির সকল রন্ধ্রেই যে উঁচু সুর বেজেছে তা নয় - আমার প্রকাশের স্রোতের মধ্যে পাপের মূর্তি যে প্রকাশ পায়নি একথা কখনওই সত্য নয় - কিন্তু নদীর জলে কাদা মিশোল থাকে বলে সেইটেই তো তার মুখ্য জিনিস নয় - সেটা সত্ত্বেও যদি তার জল স্নানে পানে কাজে লাগে তবে পৃথিবী শুদ্ধ লোক তো তাকে ক্ষমা করে - সেই ক্ষমা যদি দ্বিজেন্দ্রবাবুর কাছ থেকে একেবারে না পাই তবে আমার কবিত্বের গ্লানির চেয়ে তাঁর চিত্তের গ্লানির জন্য আমি বেশি বেদনা পাব। এই গ্লানি কবে এবং কেমন করে দূর হবে জানি নে কিন্তু প্রার্থনা করি এই কালিমা সম্পূর্ণ কাটিয়ে তিনি তাঁর প্রতিভাকে পবিত্র করুন।"

 

       এ কথাগুলো শান্তির জল। আজ চারদিকে যা কলতলার ঝগড়া, "হাম্বা হাম্বা" ডাক রামকৃষ্ণের ভাষায়, তাই এইটুকু স্মরণ করে নিলে চিত্তশুদ্ধি হয়।

       ওদিকে ম্যাকমিলন ছাপাখানা থেকে গীতাঞ্জলি বেরোবে স্থির হয়েছে। কবি য়েটস সে বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু ভয়, রবীন্দ্রনাথ যদি কাটাকুটি করে বসেন, তাই রবীন্দ্রনাথের স্বভাবের কথা ভেবে কবি য়েটস রোদেন্সটাইনকে সাবধান করছেন,

"I don’t want anything crossed out by Tagore's modesty."

       এইগুলিই সম্পদ।