শিখেরা গুরুগ্রন্থসাহেবকে গুরু বানাতে পারে যদি, কথামৃত গুরু হতে পারে না?
পারে। বেশ পারে। গুরুগ্রন্থসাহেবে যেমন নানা জায়গা থেকে বাণী সংকলন আছে, কথামৃতে তেমন কি নেই? সব ধর্মের সারটা সেখানে আছে। আচ্ছা আমি না হয় মুখ্যু মানুষ হলাম, স্বয়ং মাস্টার মশায় কি বলছেন শোনা যাক, তিনি তো অত পড়াশোনা জানা শিক্ষিত মানুষ। মাস্টার মশায় ২৬শে অক্টোবর, ১৮৮৪ সালে লিখছেন---
"শ্রীযুক্ত মহিমাচরণাদি ভক্তেরা বসিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের হরিকথামৃত পান করিতেছেন। কথাগুলি যেন বিবিধ বর্ণের মণিরত্ন, যে যত পারেন কুড়াইতেছেন—কিন্তু কোঁচড় পরিপূর্ণ হয়েছে, এত ভার বোধ হচ্ছে যে উঠা যায় না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আধার, আর ধারণা হয় না। সৃষ্টি হইতে এ পর্যন্ত যত বিষয়ে মানুষের হৃদয়ে যতরকম সমস্যা উদয় হয়েছে, সব সমস্যা পুরণ হইতেছে। পদ্মলোচন, নারায়ণ শাস্ত্রী, গৌরী পণ্ডিত, দয়ানন্দ সরস্বতী ইত্যাদি শাস্ত্রবিৎ পণ্ডিতেরা অবাক্ হয়েছেন। দয়ানন্দ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে যখন দর্শন করেন ও তাঁহার সমাধি অবস্থা দেখিলেন, তখন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আমরা এত বেদ-বেদান্ত কেবল পড়েছি, কিন্তু এই মহাপুরুষে তাহার ফল দেখিতেছি; এঁকে দেখে প্রমাণ হল যে পণ্ডিতেরা কেবল শাস্ত্র মন্থন করে ঘোলটা খান, এরূপ মহাপুরুষেরা মাখনটা সমস্ত খান। আবার ইংরেজী পড়া কেশবচন্দ্র সেনাদি পণ্ডিতেরাও ঠাকুরকে দেখে অবাক্ হয়েছেন। ভাবেন, কি আশ্চর্য, নিরক্ষর ব্যক্তি এ-সব কথা কিরূপে বলছেন। এ যে ঠিক যীশুখ্রীষ্টের মতো কথা! গ্রাম্য ভাষা! সেই গল্প করে করে বুঝান—যাতে পুরুষ, স্ত্রী, ছেলে সকলে অনায়াসে বুঝিতে পারে। যীশু ফাদার (পিতা) ফাদার (পিতা) করে পাগল হয়েছিলেন, ইনি মা মা করে পাগল। শুধু জ্ঞানের অক্ষয় ভাণ্ডার নহে, — ঈশ্বরপ্রেম 'কলসে কলসে ঢালে তবু না ফুরায়'। ইনিও যীশুর মতো ত্যাগী, তাঁহারই মতো ইঁহারও জ্বলন্ত বিশ্বাস। তাই কথাগুলির এত জোর। সংসারী লোক বললে তো এত জোর হয় না; তারা ত্যাগী নয়, তাদের জ্বলন্ত বিশ্বাস কই? কেশব সেনাদি পণ্ডিতেরা আরও ভাবেন,—এই নিরক্ষর লোকের এত উদারভাব কেমন করে হল! কি আশ্চর্য! কোনরূপ বিদ্বেষভাব নাই! সব ধর্মাবলম্বীদের আদর করেন—কাহারও সহিত ঝগড়া নেই"।
তো এ হেন বই গুরু হতে পারে না? শিখেদের মত করে ভাবতে দোষ কি আছে?
আমার এক আত্মীয় ছিলেন। সারাটা জীবন অমানুষিক পরিশ্রম করে এপার বাংলায় পায়ের তলায় একখণ্ড জমি পেয়েছিলেন একদম শেষের দিকে এসে। এসেছিলেন তো কপর্দকশূন্য হয়ে। শেষের দিকে দেখতাম সারাদিনে মাঝে মাঝেই কথামৃত খুলে বসতেন। চোখ মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠত। আমাকে নানা কথা বলতেন। কথামৃত থেকে। তাঁর অনুভব। বলতেন মনটা যেন মুছে দিচ্ছে কেউ। আহা! কি যে আনন্দ হত ওঁকে দেখে। ওঁর ওই প্রসন্ন মুখটা দেখে। উনি কোনোদিন মঠে-মন্দিরে যেতেন না। কোথাও দীক্ষা নেওয়ার জন্য ভাবনা রাখতেন না। জানতেন ওই কথামৃতেই সবটুকু পাচ্ছেন।
বাবার দুই বন্ধু ছিলেন। একজনের খুব অল্প বয়সে খুব কঠিন শরীর খারাপ হয়। বাঁচার আশা প্রায় নেই বললেই হয় এমন নাকি হয়েছিল। আমার এত ছোটোবেলার কথা সেটা যে আমার জানা নেই। কিন্তু ওঁকে দেখেছি আমার স্কুলে পড়ার বয়সে। বেশ উঁচু পদে কাজ করতেন। অ্যাটাচি নিয়ে অফিসে যেতেন। সেই অ্যাটাচিতে সব সময় থাকত একটা আনন্দ পাবলিশার্সের ছোটো কথামৃত। বলতেন যে সময়ে জানলাম আমার অবস্থা ভালোর দিকে নয়, আমায় কেউ দেখতে এলে অল্প অল্প করে পড়তে বলতাম এই বই। আবার যখন সুস্থ হওয়ার দিকে, তখন নিজে নিজেই পড়তাম। মনে হত জগতে যা কিছু ভালো কথা সব এখানেই লেখা আছে।
বাবার আরেক বন্ধু, রিট্যায়ার করার বছর খানেক আগেই গুরুতর অসুস্থ হলেন। এবং চাকরি থাকতে থাকতেই চলে গেলেন। আমি যখনই ওঁকে দেখতে যেতাম আমায় বলতেন কথামৃত পড়ে শোনা।
আমি শোনাতাম। উনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতেন। চোখের কোণা মাঝে মাঝে চিকচিক করে উঠত। পাঠ শোনার সেই সময়টা অন্তত ওঁর চোখেমুখে রোগের ছাপ সেভাবে আসত না। পড়া হলে এক অদ্ভুত প্রসন্নতামাখা হাসি হাসতেন। বলতেন, এই সার কিছু কথা হল।
আরেকজন মানুষ। আমরা সবাই তাঁকে জেঠু বলে ডাকতাম। অকৃতদার। ভালো চাকরি করতেন। গোটা সংসারকে নিজে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, মানে ভায়েদের আরকি। বিয়ে দিয়ে সংসারী করিয়েছেন। উনি বলেছিলেন, জানিস একবার ইচ্ছা হল মাধবানন্দজীকে দেখতে যাব। মাধবানন্দজী মঠের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যেমন পাণ্ডিত্য, তেমনই কর্মযোগী, সেবাব্রতী। তো জেঠুর তখন অল্প বয়েস। গেলেন দেখা করতে। গিয়ে দেখেন বসে বসে কথামৃত পড়ছেন। তিনি জেঠুকে বলেন, "আমায় আর কি দেখার আছে হে, এ তোমারই মত রক্তমাংসের খাঁচা। এই বই পড়ো, এতেই সব হবে।"
কাশী বড় বিচিত্র জায়গা। ফ্লাইওভারের তলায় এক সন্ন্যাসীকে দেখেছিলাম, এক কোণে ঘুমাচ্ছেন, মাথার কাছে এক পুঁটলি, আর তার পাশে কথামৃত রাখা।
কথামৃত নিয়ে স্মৃতির শেষ নেই। কয়েকটা মাত্র বললাম। তা মনে হয় এই বই কি গুরুগ্রন্থসাহেবের মত গুরু হতে পারে না? মা সারদা যখন মাষ্টার মশায়ের কাছে কথামৃত শুনেছিলেন, তখন বলেছিলেন তো,
"বাবাজীবন,
তাঁহার নিকট যাহা শুনিয়াছিলে সেই কথাই সত্য। ইহাতে তোমার কোন ভয় নাই। এক সময় তিনিই তোমার কাছে ওই সকল কথা রাখিয়াছিলেন। এক্ষণে আবশ্যকমত তিনিই প্রকাশ করাইতেছেন। ওই সকল কথা ব্যক্ত না করিলে লোকের চৈতন্য হইবে নাই জানিবে। তোমার নিকট যে সমস্ত তাঁহার কথা আছে তাহা সবই সত্য। আমি একদিন তোমার মুখে শুনিয়া আমার বোধ হইল যে তিনিই ওই সমস্ত কথা বলিতেছেন।
জয়রামবাটী, ২১ শে আষাঢ়, ১৩০৪"
তবে? যা শুনে চৈতন্য হয়, সে গুরু না তো আর কে হবে?
আজ ধর্ম নিয়ে এই যে এত সঙ্কীর্ণ মত, দলাদলি, ভুল বোঝাবুঝি…. আরো কত কি…. বলি হ্যাঁ গা… ঠাকুরকে পড়লে, জানলে, শুনলে ঠিকঠাক বোধ হয় না?
আমার তো মনে হয়, হয়। সেই যে কোন কাল থেকে আজ এই বুড়ো হতে চললাম, এই যে নিত্য কথামৃতের কাছে আসছি, একদিনও তো শূন্য হাতে ফিরলাম না!
এমন সুহৃদ, এমন সৎপরামর্শদাতা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তো দাদা বড় দুর্লভ। ইনি তো কিছুই চান না। যাকেই দেখতেন, বলতেন, এসো। আবার সময় করে এসো। এমনকি অতি সাধারণ মানুষও অনেক দিন দেরি করে গেলে বলতেন, হ্যাঁ গা, এত দেরি করে আসতে হয়?
তো কথামৃতের পাতা খোলা মানেই তো দক্ষিণেশ্বরে যাওয়া, শ্যামপুকুরবাটি যাওয়া, কাশীপুর যাওয়া। আমি যে তাঁর কাছে আশ্রয় চাইছি, সে তো আমি পাতা খুললেই উনি টের পাচ্ছেন। পাচ্ছেন না? বেশ পাচ্ছেন। পাতার পর পাতা ডুবিয়ে নেয় নইলে কি যাদুতে?
তাই বলছিলাম, কথামৃতই কি আমাদের গুরুগ্রন্থসাহেবের মত একটা কিছু হতে পারে না? বেশ পারে। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।
সব শেষে শ্রী শ্রী ঠাকুরের শিক্ষা অনুসারেই বলি, যেমনভাবে তিনি সব্বাইকে প্রণাম জানাতেন, সে পদাঙ্ক অনুরসরণ করেই সবাইকে প্রণাম জানাই। ঠাকুরের প্রণাম দিয়েই শেষ করি।
"কীর্তনান্তে শ্রীরামকৃষ্ণ ভূমিষ্ঠ হইয়া জগন্মাতাকে প্রণাম করিতেছেন। প্রণাম করিতে করিতে বলিতেছেন, “ভাগবত-ভক্ত-ভগবান, জ্ঞানীর চরণে প্রণাম, ভক্তের চরণে প্রণাম, সাকারবাদী ভক্তের চরণে, নিরাকারবাদী ভক্তের চরণে প্রণাম; আগেকার ব্রহ্মজ্ঞানীদের চরণে, ব্রাহ্মসমাজের ইদানীং ব্রহ্মজ্ঞানীদের চরণে প্রণাম।”