একজন মানুষ যখন খোলা আকাশে ডানা মেলে বলে আমার বাসার দরকার নেই, তখন সবাই বলে কত তোমার ডানার জোর দেখব। আবার সেই মানুষটা যখন মানুষের উপর গভীর অভিমানে বাগানের ফুলগুলোকে বলে, আমার মানুষের দরকার নেই আর, তখন সবাই মুখ বেঁকিয়ে বলে, বাড়াবাড়ি, কোলাব্যাঙ ব্যাটা অহংকারী।
ধুম করে চায়ের কাপটা মাটিতে পড়ে গেল। বলাকওয়া নেই, প্রাকভূমিকা সাজসজ্জা নেই, মানুষটা হাপিশ। নেই। শুধু মানুষটার মত দেখতে শরীরটা এলিয়ে চেয়ারে পড়ে থাকল। এখন যার দরকার বলতে সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী এখন কিছুটা আগুন। পুড়িয়ে দিলেই সমাজ পবিত্র। যা সে নিজে করতে পারবে না।
আদর্শ মানে অনেকের কাছে গায়ের জামা, গায়ের চামড়ার বাইরে লেগে থাকা বাজারি জিনিস। চামড়ার ভিতরে ঢোকে না। আবার অনেকের কাছে রক্তের ছন্দ, স্নায়বিক আঠা। পাকা দাড়ি, সুনির্মল মুখটা আজ যখন তার নিজের হাতে অতি যত্নে গড়া বাগানে শুয়ে আছে, সে কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাস করত না, আবার শেষের দিকে মানুষেও বিশ্বাস করত না, কিন্তু তার একদিন কোনো এক আদর্শে বিশ্বাস ছিল। কিন্তু শেষের দিকে বিশ্বাস করত ফুলে আর শিশুতে শুধু। পাড়ার শিশু আর বাগানের ফুলের বাইরে বাকি সবার সাথে তার ছিল দরকারের সম্পর্ক। তার একটা সামাজিক স্বপ্ন ছিল। সাম্য আসবে, সম্পূর্ণ না হলেও কিছুটা অন্তত। এত শোষণ, পীড়ন, এক্সপ্লয়েটেশান থাকবে না। এই সব আর কি। তাই কি হয়? যাদের মেরুদণ্ডের জোরের জন্য লড়তে গেল তারা তারই মেরুদণ্ডে করল আঘাত। সে তবু লড়ল। আবার সন্দেহ করল তারাই, সে সন্দেহের মুখোমুখি হতে চাইল। কিন্তু এক সময়ে তার মনে হল ধুর!
আদর্শ মানে আগুন। আদর্শ মানে পাগলামিও। কদিন আগে কি একটা শুনলাম না? কারা যেন বলছে কোন মহাপুরুষ যেন তার ধম্মকম্ম হারিয়ে এসে গেল বুঝি রাজনীতিতে। ব্যস, অমনি চাদ্দিকে কাড়ানাকাড়া বেজে উঠল, হায় হায়, এতবড় মহাপুরুষ যদি রাজনীতিতে আসে তবে দেশে মহাপুরুষ একখানা কম পড়বে না? সেকি লেখালেখি, সেকি কান্নাকাটি বাবা। আবার কেউ কেউ বলল, না, তা কেন, অমন একজন ব্রহ্মচর্যপালনী যদি আসে, সে তো ভালো কথা, স্থিতধী মানুষের কি দরকার নেই?
আমার এ সব তর্জা শুনে বেজায় হাসি পেল। সেই দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দৃশ্য মনে পড়ে গেল। কেউ বলেনি এ অন্যায় হচ্ছে, দুঃশাসন তুমি থামো... দুর্যোধন এ কি হচ্ছে... মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আপনি কেন চুপ! হে ভীষ্ম আপনি কেন চুপ করে বসে আছেন? থামান! কেউ বলেনি। তখন মনে হল যাকে নিয়ে এত জল্পনা, সেই মানুষটা যে ঘরের, সেই ঘরের যে রূপকার তার স্বপ্নের ওপর আঘাতের সময় যখন তারা দ্রষ্টা শুধু, অদৃষ্টবাদী, তখন এ খেলা তো লুকোচুরি শুধু। সেই ঘরই যখন রাজানুগামী, সত্যভাষাহীন, আদর্শচ্যুত, তখন তাদের গা বাঁচিয়ে আড়ালে খেলাধুলা করার চাইতে কলিজাতে আর কি কিছুর জোর আছে? নেই। সব বিক্রি হয়ে গেছে। আছে কিছু সেদিনের কঙ্কাল, আর সেই কঙ্কালের ভণ্ড পুজারির দল। যারা প্রাণ খোঁজে না, শুধু কাঠামোতেই তুষ্ট। কাঠামোতেই ভোলায়।
তো যার গল্প বলছিলাম, সে অভিমানী মানুষটা তো নিঃশব্দে কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেল। যারা ডানার মাপ নিতে চেয়েছিল, যারা শেষের দিনে বাগান আর শিশু নিয়ে থাকা মানুষটাকে সঠিক শিক্ষা দেবে ঠিক করেছিল, তারা বেজায় চটে গেল। ওরকম একটা হৃদযন্ত্র রাখার কি দরকার বাপু বুকে, যে বিনা পরামর্শে ধুম করে থেমে যায়? যত্তসব!
থেমে গেল হঠাৎ করে সব। এ বারের শীতে যে ডালিয়াগুলো লাগানোর কথা ছিল, যে পরিচর্যা শুরু হব হব করছিল। সব থেমে গেল। চোখ-কানের খাতা বন্ধ হল, আর কিছু লেখা হবে না। মানুষটা অতীতের ঘটনাগুলো ভেবে আর কষ্ট পাবে না। তার কথা কারোর মনে থাকবে? মনে হয় না। কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের মনে থাকবে কিছুদিন। তারপর সবাই ভুলে যাবে। সেইতেই মঙ্গল। স্মৃতির ঘরে অনেক পোকা। ব্যক্তিত্ব আর ইগোর মধ্যে একটা পার্থক্য আছে, একটায় সুগন্ধ, আরেকটায় আঁশটে গন্ধ। অনেকেই গুলিয়ে ফেলে। নিজের ইগোর দুর্গন্ধটাকে ভাবে ওর ব্যক্তিত্বের থেকে আসছে হয় তো। লোকটাকে একটু খুঁটে দেখে। খুঁটতে গিয়ে যখন দেখে তার নিজের নখের থেকে সুগন্ধ আসছে, তখনই বুঝে যায় আসলে দুর্গন্ধটা কোত্থেকে আসছিল। ব্যস, ছুট দেয়। আর যত রাজ্যের গালাগালি থাকে, নিন্দাকথা থাকে সব বলতে শুরু করে তার নামে। যেন নিজের দুষ্টু লুকানো সত্তাটাকে প্রকাশ্যে তার গায়ে জড়িয়ে দেয়। আরাম লাগে। আবার ভয়ও লাগে। সবার দুষ্টু মনের তলায় একটা ক্যাবলা মন থাকে তো, যে সবটা সোজা বোঝে, কিন্তু নিজের দুর্বলতার জন্যে বলে উঠতে পারে না। তাই এই ক্যাবলা মনটাকে নিয়ে ভয়ও লাগে। কোনোদিন যদি অন্য কারোর ক্যাবলা মনের সাথে দেখা হয়ে যায়? যদি চোখের ভাষায় চিনে ফেলে নিজেদের? তবে? তখন কি হবে?
সে যাই হোক। এ সব আবর্জনা থেকে আমার গল্পের সে মানুষটা আজ অনেক দূরে। এই যা শান্তি। আগুনে কাঠামোটাও শেষ এতক্ষণে।