সে যখন মধ্যরাতে নদীর তীরে এলো, তখন চাঁদ অস্ত গেছে। তারার আলো।
সে হেরে গেছে। ভেঙে গেছে সব স্বপ্ন, আশা, ভবিষ্যতের সব পাথেয়।
সে নদীর বুকে এক পা, এক পা করে নামছে, তার শরীর, মন এত অবসন্ন বিষাদে যে সে ভয় পাওয়ার অনুভূতিটুকুকে অনুভব করতে পারছে না।
জল যখন কোমর অবধি এসে গেছে, হঠাৎ পিছন থেকে কে বলল, দাঁড়া।
সে ফিরে তাকালো। কেউ তো নেই পাড়ে। ভুল শুনল। হাসি পেল। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ হয় তো এভাবেই নিজেকে শেষ সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। কে জানে? সবার জীবনেই তো মৃত্যু একবারই আসে।
সে গলা জল অবধি নামতে আবার ডাক এলো পিছন থেকে, দাঁড়া বলছি!!
সে আবার ঘুরে তাকালো। অন্ধকারে মনে হল কে যেন দাঁড়িয়ে আছে পাড়ে। তার দিকে তাকিয়ে। তাকে ডাকছে তারার আলোয় ভরসা রেখে।
সে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ঢেউ বলল, যা। বাতাস ডাকল, যা। অন্ধকারের সেই মূর্তি বলল, আয়।
সে জল ঠেলে ঠেলে এগোতে শুরু করল পাড়ের দিকে। কে দাঁড়িয়ে? কিন্তু আর পারছে না সে, শরীরের সব কটা স্নায়ু বেয়ে বইছে বিষাক্ত স্রোত, অবসাদের। ভাগ্যের সঙ্গে লড়াইয়ে আজ সে কপর্দকশূন্য। কার কাছে ফিরবে? নিজের কাছে ফেরারও যে কোনো অর্থ নেই আজ। তবে?
পাড়ে এসে দাঁড়ালো। পায়ের পাতা ডুবে আছে কাদায়। যে তাকে ডাকছিল, সে কাঠামো। বিসর্জিত দুর্গার কাঠামো। দাঁড়িয়ে আছে মাসের পর মাস, অনর্থক। যা ছিল পূজ্য, আজ সে তাচ্ছিল্য, অবহেলার।
তার নিজের মনের উপর ধিক্কার জন্মালো। এখনও নিজের সঙ্গে ছল…. হা ঈশ্বর!
আবার ফিরতে যাবে, এবার স্পষ্ট শুনল, যাস না, দাঁড়া, তাকা আমার দিকে।
সে ফিরে তাকালো। বলল, সত্যিই তুমি ডাকছ?
কাঠামো বলল, হ্যাঁ, তাকা আমার দিকে… তাকা… কি দেখছিস?
সে বলল, কঙ্কালসার, মলিন তোমার কাঠামো…..
কাঠামো বলল, হ্যাঁ… এই কাঠামোই সত্যিই… ওই পুজো, উৎসব, রঙ, মাটি, বেশভূষা, অলঙ্কার, ঢাকঢোল, ধূপধুনো, উল্লাস… সব মিথ্যা… সব….. তোর মধ্যেও একটা কাঠামো আছে…. সে কাঠামোটাকে খোঁজ… কাঠামোতে স্থির থাক…. এক বিন্দু নড়িস না… যা হারিয়েছে ভাবছিস সে শুধু বাইরের…. কাঠামো হারায় না…. আমায় তুলে নিয়ে গিয়ে আবার মাটি দেবে, আবার রঙচঙ করে প্যাণ্ডেলে নিয়ে আসবে… আবার শুরু হবে চারদিনের উৎসব… সব মিথ্যা….
সে বসে পড়ল কাদায়। বলল, আমার দাঁড়াবার শক্তিটুকু নেই…. খুঁজি কিসের জোরে…..
কাঠামো বলল, জেদ….. তোর এই রক্তমাংসের শরীরের কাঠামো যেমন কঙ্কাল… তেমন তোর মনের কাঠামো জেদ…. জেদ হারাস না… ওকেই বলে শ্রদ্ধা… আত্মশ্রদ্ধা….. বেঁচে থাকার জেদ….. খুঁজে দেখ… সেই জেদই তোর আনন্দ… তোর শক্তি… তোর উৎসাহ…. ওই জেদটুকুই তুই…. সব যখন অনুকূল, তখন মনে হয় মাটিই আসল… বেশভূষা অলঙ্করণেই আসল…. বিসর্জনের পর বোঝা যায় কি আসল…. সব স্বপ্ন, ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে যেতে শুরু করলে একে একে, বোঝা যায় কি আসল…. আসল ওই জেদ…. তোর আত্মশক্তি….. উঠে দাঁড়া…. কাঠামোর জোরে উঠে দাঁড়া… কাঠামোতে কাউকে হাত দিতে দিবি না…. কাঠামোই তুই… আসল তুই…. যা বাড়ি যা…. সব হারালেও নিজের উপর নিজের অধিকার হারায় না কেউ… নিজের কাঠামোর উপর অধিকারই আসল.. যা ফিরে যা……
সে তাকালো নিজের দিকে। আশ্চর্য কিসের জোরে সে জলে ডুবতে এসেছিল… সে শক্তি সে কোথা থেকে পেল?
কাঠামো বলল, মাটি, বেশভূষা, অলঙ্করণকে যদি খাঁটি বলে চিনতাম… তবে আমিও কাঠামোকে ভাসিয়ে নিজেকে নি:শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবতাম…. তা হয় না…. যা তুই…. নিজেকে নিজের জেদের শক্তিতে চিনে নে…. উঠে দাঁড়া…..
সে সত্যিই উঠে দাঁড়ালো। বলল, যদি না পাই?
কাঠামো বলল, যা নিজের তা চিরকালই নিজের….. বাইরের সান্ত্বনা আর ভিতরের বিষাদ… এই দুইয়ের হাত থেকে নিজের কাঠামোকে রক্ষা করে চল…. কঠিন হ…. বাঁচ…. বেঁচে থাক…..