সাদা কেটস কিনে দিত বাবা। জুটমিলে কাজ করত। আমরা তিন বোন, এক ভাই। আমি সবার বড়, দিদি। ওই কেটসই পেতাম প্রতি বছর। স্কুলেও ওই দিয়েই হয়ে যাবে তাই।
যে জামাটা পছন্দ হত, কোনোবারই কেনা হত না। বাবার সাইকেলের পিছনে বসে যেতাম দোকানে। বাবা যে জামা কিনে দিত, পছন্দ হত না, একবার এত কেঁদেছিলাম যে বাবা সাইকেল থেকে নামিয়ে দিয়েছিল। কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে হেঁটেই বাড়ি ফিরেছিলাম, প্রায় চার কিলোমিটার।
এ বছর আমার ছেলেটা জামা প্যান্ট কিনল প্রায় আট হাজারের উপর। আমারই রোজগার, কলেজে পড়াই। স্বামী নেই। বাবাকে একটা পাঞ্জাবি দিলাম। মা নেই।
বাবা একা থাকে। আমি যখন পাঞ্জাবিটা দিয়ে উঠতে যাব, বাবা বলল, "আমার সাথে এদিকে আয় একবার।" বাবার পিছনে পিছনে গেলাম, আমার সাথে শুভায়ু, এইবার মাধ্যমিক দেবে।
বাবা সিঁড়ির তলায় ঝুঁকে একটা বড় কাঠের বাক্স বার করল। পরিষ্কার বাক্সের উপরটা। মালতীদি মহালয়ার আগে সব ঝেড়ে পরিষ্কার করেছে। এমনিতেও করে, বাবার COPD আছে।
বাক্সটা খুলতে আমার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। আমাদের কেটসগুলো! আমি ঝুঁকে বসে একটা একটা করে বার করলাম। আমার পাশে বসল শুভায়ু, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, অদ্ভুতভাবে উচ্চারণ করল, "কেইটস!"
বেশিরভাগই ছেঁড়া, কিন্তু পরিষ্কার। বাবা পিঠে হাত রাখল। আমার চোখ জলে ঝাপসা। অভিমানে, কষ্টে, দুঃখে। সামলে বললাম, "তুমি এসব জমিয়ে রেখেছ কেন? জানো না এতে ধুলো হবে, তোমার অসুবিধা হবে?"
আমি জানি আমি অযৌক্তিক কথা বলছি। আসলে আমার বলার কিছু নেই, কান্না চাপার আছে। এমনিতেই পূজো মানেই চাপা কান্না, মায়ের জন্য।
বাবা হাসল। বলল, "এদিকে দেখ।"
শুভায়ু একটা কেটস পায়ে গলিয়ে ফিতে বাঁধছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "মাম্মি এগুলো ইয়োরস? আই মিন ইয়োর চাইল্ডহুড মেমোরি?"
চোখের ঝাপসা বাঁধ গালে গড়ালো। বললাম, "হুম।"
গাড়িতে আমি আর শুভায়ু ফিরছি। পরিতোষের পছন্দের গাড়ি। ডাক্তার ছিল। অথচ নিজে বুঝতে পারেনি লিভারে এমন মারণ রোগ বাসা বাঁধছে। গাড়িতে উঠলেই ওর ডিও'র গন্ধে ম ম করত। প্রথম প্রথম খুব রেগে যেতাম, আমার গা গুলিয়ে যেত। পরে অভ্যাস হয়ে গেল। এখন তো ওই ডিওটা স্প্রে না করে আমি গাড়িতে উঠতেই পারি না। গন্ধটা না থাকলেই আমার গা গুলিয়ে যায় যেন।
আমি চোখ বন্ধ করলাম। শুভায়ুর পায়ে কেটস, আমার না ভাইবোনেদের, জানি না। আমার নিজের ছোটো পা'টা মনে পড়ছে। ধবধবে সাদা কেটস।
সবাই আমায় তাদের সাইকেল থেকে নামিয়ে দিয়েছে, ওর বাবা, আমার মা, ছোটোবোনটা, যার ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছিল। কিন্তু কিসের বায়না করেছিলাম আমি? ভালোবাসার? আমার কাছে এমন অমূল্য হয়ে গেল?
আজ পঞ্চমী।