এক এক সময় যখন অনুবাদ পড়ি মনে সংশয় হয়, মূলটায় এসব আছে তো? লেখক নিজে কিছু নিজের থেকে ঢোকাননি তো?
ভাবুন কাশীরাম দাসের কথা। তিনি মহাভারত লিখছেন বাংলায়। ভালোই চলছিল লেখাটা, কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে কি গোলমেলে কাণ্ডটাই না ঘটিয়ে বসলেন! যেখানে অর্জুনের সাথে কৃষ্ণের কথোপকথন, যাকে গীতা বলছি আমরা। কি কাণ্ড শুনবেন? এক তো বেদব্যাসের গীতার সাথে কাশীরামদাসের গীতার প্রায় মিল নেই বললেই চলে, তার উপরে রীতিমত সতীদাহ প্রচার করে বসেছেন! অ্যাঁ!! বলে কিনা কৃষ্ণ গীতায় সতীদাহের কথা বলেছেন!
বাণপ্রস্থ-ধর্মে থাকি তপস্বী-লক্ষণে।
আমারে চিন্তিয়া দেহ ত্যাজি যোগাসনে।।
দিব্যরথে চড়ি যাবে ইন্দ্রের ভবনে।
সহমৃতা হইয়া ভার্যা যাবে পতি-সনে।।
আমি দিব্য কেটে বলছি গীতায় অমন কথা একটাও কৃষ্ণ উচ্চারণ করেননি গো। কিন্তু আমি যে না সংস্কৃত'র অনুবাদ, মূল সংস্কৃত পড়িচি --- তাই জানি। সেইকালের সংস্কৃত না জানা মানুষগুলোর কথা ভাবুন দেকিনি! আচ্ছা, তারা তো ভাববে মানুষটা অমন কথা বলেছিল গীতায়, বিশ্বাস করবে, এমন কি পালন করার জন্য পীড়াপীড়িও করবে।
বলি হ্যাঁ গা, এ কিরকম মিছে কথা প্রচার! এতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়নি! এমন কথাগুলানরে কেউ কাটেনি! কি অনাচার ভাবুন তো বলেন দিকি!
আরেকটা গোলমেলে কথা। এত বড় পাপের কথা নয়, তবু মনুর ল্যাজ ধরে কৃষ্ণের মুখ দিয়ে কি কথা বসিয়ে ছাড়লে গো। শুনুন,
শূদ্রকূলে মহাধর্ম দ্বিজের সেবায়।
সর্বকর্ম সমর্পিবে ব্রাহ্মণের পায়।।
দাস্যভাব করিয়া সেবিবে দ্বিজগণে।
ইথে মুক্তি লভি যায় স্বর্গের ভবনে।।
অবিদ্য সবিদ্য দ্বিজ বেদহীন হয়।
তথাপি তাহারা মোর তনু, ধনঞ্জয়।।
কি বললেন বুঝলেন! মানে ব্রাহ্মণ যদি বিদ্যাহীন, বেদহীন --- যাই হোক না কেন, সে পূজ্য শুধু না, শূদ্রের যাবতীয় জীবনের সেব্য, আর সে নাকি আর যাই হোক তবু সে ভগবানের শরীর!
বলি হ্যাঁ গা কাশীদা, কৃষ্ণ কবে এমন কথা গীতায় বলল দাদা? সে তো বলেছে যে নয়টা গুণ না হলে সে ব্রাহ্মণই নয়, ক্ষমা, তপস্যা, সত্যবাদিতা ইত্যাদি, তা তুমি এমন কথা কোই পাইলা দাদা? গীতাখানা কি পড়ো নাই? বলি সমাজের মধ্যে এমন সঙ্কীর্ণ দুষ্ট-পক্ষপাতযুক্তনীতি লিখতে কলম কাঁপল না গো! সমাজের লক্ষ লক্ষ সংস্কৃত জ্ঞানহীন আবালবৃদ্ধবনিতা যে এই কথাগুলোই সার কথা জেনে পালন করে সমাজের মেরুদণ্ডটা ভেঙে দেবে একবারও কথাটা মনে এল না?
ভাবি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কত বিষ এভাবে যুগযুগ ধরে ঢুকেছে ভাবুন! গা শিউরে ওঠে। এতটা বিকৃতিকে মানুষ মাথায় নিয়েছে!