"কর্তব্যটুকু করে যাই, তারপর যা হবার ঈশ্বরই জানবেন।"
নার্সকে কথাটা শেষ বলেছিল। এই বাক্যটা বলে আসছে একত্রিশ বছর বয়েস থেকে। আজ এই চুয়াত্তর বছর দশমাস তিনদিনের দিন শেষবার উচ্চারণ করল। কথাটা বলে শুলো। আর জাগল না।
সংসারেও সবাই জানে সে সারাজীবন সব কর্তব্য নিখুঁত করে গেছে। কারোর কোনো অভিযোগ নেই ওর প্রতি। কারোর কোনো ভালোবাসাও নেই। সম্মান, শ্রদ্ধা আছে। যেমন মানুষের দামী আসবাবের উপর থাকে। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে - সবাই দুঃখ পেল। কিন্তু শোক পেল না। সবাই তো জানে সে কর্তব্য করতেই ভালোবাসত, হৃদয় বলে কিছু ছিল নাকি! শুধু মেয়ের মেয়ে যে, খুব আদরের নাতনি, সে কাঁদল। শোকের কান্না কাঁদল। বাড়ির বাদবাকিরা সবাই খুব অস্বস্তিতে পড়ে যাচ্ছিল। স্ত্রী তো রীতিমতো বিরক্তই হচ্ছিল। নিজের কান্না যেন কলচাপা জল, বাচ্চাটার কান্না যেন বৃষ্টির জল। দাদু যেন আর কারো মরে না! অবশ্য বাচ্চা, ওকি বোঝে? ঈশ্বরই জানেন, কি কঠিন প্রাণের মানুষের সঙ্গে ঘর করতে হয়েছে। প্রতিটা চিনি গোনা থাকত। কি সুখ পেয়েছি আমি সারাজীবন! কিন্তু এখন ক্ষোভের কথা থাক। কিছু ক্ষোভ না থাকলে জীবনে আর কি বেঁচে থাকে? যেন দোকানি দোকানের ঝাঁপ না ফেলে বসে আছে, অথচ সব বিক্রি হয়ে গেছে। থাক, কিছু ক্ষোভ থাক। বড় যত্নে গোপনে রাখা ক্ষোভের মালা। সময়ে সময়ে জপে বসে। চোখে জল আসে। বুকটা হালকা হয়ে যায়।
হরিনামের চাদরে ঢাকা মানুষটা সামনে শুয়ে। যে মানুষটা বিয়ের পর বুঝেছিল, যে মানুষের সিঁথিতে সিঁদুরের দাগ টানল সে মানুষটা তার কৈশোর, যৌবনের অপেক্ষার মানুষ নয়। সে বাড়ির বউ হল, তার দোসর হল না। এ বাস্তব মানুষ। মিল হল না। কিন্তু অ্যাডজাস্টমেন্ট হয়ে গেল। দুজনের বোঝাবুঝি স্পষ্ট। দুজনের গোপন দুটো আমি - তারা থেকে গেল উহ্য। আজীবন উহ্য। মানুষটা বুঝল স্ত্রীপুত্রকন্যা, অফিস, পাড়াপ্রতিবেশী, ক্লাব, সরকার, ধর্ম - সবাই একটাই জিনিস চায় তার কাছে, কর্তব্য। নিজেকে একপাশে সরিয়ে রেখে শুধু হিসাবকে টিকিয়ে বাঁচা তার অভ্যাস হয়ে গেল। মানুষ গেলে ক্ষতি হয় না, হিসাব গেলে সব গোলমাল হয় যায়। এ বিশ্বাস এমন দৃঢ়ভাবে মনের মধ্যে গেঁথে গেল যে ঈশ্বর আর তার মাঝেও হিসাব ছাড়া আর কিছু বেঁচে রইল না, স্ত্রীপরিবারের সঙ্গেও তাই। ওরা বোঝে না। পরে বুঝবে। নরম জুতোর নীচে শক্ত সোল না থাকলে হাঁটা যায় না সংসারে। কাঁটা বেঁধে। নিজেকে মনে হত সেই শক্ত সোল। তার উপরে বাঁচা কয়েকটা প্রাণীর নরম জীবন।
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যখন কথা কাটাকাটি হত, মনোমালিন্য হত, তখন মধ্যস্থতা করতেন ঈশ্বর। একজন ভাবত, আমি আমার কর্তব্যে কোনো ফাঁক রাখিনি, বাকিটা ঈশ্বর যা ভালো বুঝবেন তাই হবে। আরেকজন ভাবত, ঈশ্বরই জানেন আমি কি মানুষ নিয়ে ঘর করছি, একটা কাঠের পুতুল, এর বিচার তিনিই করবেন!
মানুষটা সত্যিই পুতুল হয়ে কাটিয়ে দিল। ঈশ্বরের কাছে এত এত হিসাব জমিয়ে রাখতে শুরু করল যে একদিন ঈশ্বর চাপা পড়ে শুধু হিসাব জেগে রইল। মা কালীর মন্দির ছিল বাড়ির কাছেই, যেতে আসতে বলত, তুমিই দেখো। বাড়ির সিংহাসনে রামকৃষ্ণ, লোকনাথবাবা, লক্ষ্মী, শিবলিঙ্গ সব ছিলেন, সকালে অফিস যাওয়ার আগে মার্বেল বাঁধানো মেঝেতে মাথা ঠুকে ঠুকে বলত, তুমিই দেখো। ঈশ্বর দেখলেন। সারা জীবন দেখলেন। বাথরুমের দেওয়ালে ঘোরা টিকটিকির মত ঈশ্বর মানুষটার সারা হৃদয়জুড়ে পায়চারি করতেন। আর দেখতেন।
ঈশ্বর এখনও দেখছেন, মানুষটা ধুপ, মালায় ঢেকে চলেছে শেষযাত্রায়। মৃত্যুটাও তো একটা কর্তব্য। নিজেকে দাহ হতে দেওয়াও কর্তব্য। সব কর্তব্য শেষ করে গেল মানুষটা।
বছর ঘুরে গেল। দেওয়ালে লাগানো ছবিটার কাঁচ ভেঙেছে কতমাস হল কারোর মনে নেই। খাটের নীচে একটা চাদরে মুড়ে রাখা। খাটের নীচে মাথা নীচু করে দেখতে ঈশ্বরের ঘাড়ে ব্যথা হয়, টাটায়। আজকাল আর তাই ঝোঁকেন না। ছবিটার উপর শুধু ধুলো জমে। আরো ধুলো জমে। চাদরটা ইঁদুরে কাটে। ছবিটা নষ্ট হয়। ফ্রেমটা নষ্ট হয়। ঈশ্বর আর খোঁজ রাখেন না। উদাসীন সূর্যের মত শিরিরবিন্দু মিলিয়ে যেতে দেখা তো আদিম অভ্যাস তার, নাকি কর্তব্য?!