Skip to main content

ডাবগুলো সব বিক্রি হল। গ্রামে ফিরছে ফাগু। সোজা রাস্তা। খুব গরম। রাস্তার ধারে একটা শিবের মন্দির। ফাগু দাঁড়ালো। পকেট থেকে একটা পাঁচটাকার কয়েন বার করে মন্দিরের বারান্দায় রাখল। ফাগু শেখের বিক্রিবাট্টা ভালো হলে কিছু টাকা দেয়। ধর্ম দেখে না। জানে সবই এক। আব্বু একতারা বানাতে পারত খুব ভালো। খোলও বানাতো দারুণ। দূর দূর থেকে মানুষ আসত। তখন ফাগু কত ছোটো। ফাগু মানুষে বিশ্বাস করে। মসজিদ, মন্দির যাই পড়ে, ফাগু সামর্থ্যে কুলালে কোনো একটা জায়গায় একটা কয়েন রেখে দেয়। মানুষের জন্য। আল্লাহ যাকে দেখাবেন সে দেখবে। নেবে। এ গভীর বিশ্বাস ফাগুর। টাকা তো মানুষেরই দরকার। মালিকের কি দরকার? ফাগুর আব্বু লালনের গান গাইত। অল্প অল্প সুর করে সেও গাইত। ফাগু একা থাকলেই আব্বুর গলার আওয়াজ শুনতে পায়। এখন যেমন পাচ্ছে। আব্বু কানের কাছে এসে বলছে একটা গান শোনা তো ফাগু… ফাগু শিব মন্দিরের চাতালে বসে। গুনগুন করছে। দূর দূর কোনো মানুষ নেই। এত গরম যে পাখিও উড়ছে না আকাশে।

একবার এই মন্দিরের ধারেই এক মরণাপন্ন বুড়ো ভিখারিকে জল দিয়েছিল মুখে। সে ছিল বৈষ্ণব। তার কোলেই মাথা রেখে মারা গিয়েছিল সে। ফাগু তাকিয়ে দেখেছিল, মানুষ মারা গেলে সবাইকে সমান দেখায়। পশু, মানুষ মারা গেলে জড় পদার্থ হয়ে যায়। জড় পদার্থের সঙ্গে জড় পদার্থের ঠোকাঠুকি লাগে না নিজে থেকে। মৃত মানুষের কোনো ধর্ম হয় না। মানুষ জ্যান্ত থাকলেই আকাম করে। জ্যান্ত থাকে, জেগে থাকে না। আব্বু বলত, ফাগু সজাগ থাক। জাগায় থাক। নইলে চোরে সিঁধ দেবে। জানতি পারবিনানে।

কে যে চোর, বলেনি আব্বু। কিন্তু ফাগু যেন অল্প অল্প বুঝছে। জাগায় থাকা মানে বুঝছে এই চল্লিশ পেরিয়ে পঞ্চাশের দোরগোড়ায় এসে। ফাগু জাগায় থাকে। জাগায় থাকা মানে সুরে থাকা। ফাগু একা থাকলে গান গায়। লালনের গানই গায় বেশি। লালনের গানে বুকের দরজায় হাওয়া লাগে। পাল্লা খুলে যায়। ভিতরের মানুষ বাইরে বেরিয়ে আসে। হাওয়া খায়। আকাশ দেখে। পাখি দেখে। সবুজ ঘাস দেখে। মানুষের চোখে চোখ রেখে মানুষ খোঁজে। ভিতরের মানুষ সবার ভিতর এক। সে দরদী। দরদীকে সরিয়ে দিলে ভিতরে যে থাকে সে শয়তান। তার চালচলন ভালো লাগে না ফাগুর। অনেক মানুষের চোখেমুখে তাকে দেখেছে। সে অনিষ্ট করে। মানুষই মানুষের অনিষ্ট করে। দরদী হলে করে না।

ফাগু উঠতে যাবে, এমন সময় একটা বাচ্চা ছেলে এলো। কাঁধে ব্যাগ। বলল, এখানে খাবার জল আছে গো কোথাও?

ফাগু বলল, মন্দিরের পিছনে যা, একটা কল আছে।

ফাগু সঙ্গে গেল। কল টিপে দেবে। এত বাচ্চা, ও তো হাতেই পাবে না।

ছেলেটা চোখেমুখে জল দিল। বারো তেরো বছর হবে। রোগা, রোদে পোড়া মুখ। সকাল থেকে কিছু পেটে কিছু জুটেছে বলেও তো মনে হল না।

সে অনেকটা জল খেলো। তারপর মন্দিরের বারান্দায় এসে বসল। ছেলেটা বলল, আমি এই গ্রামে আগে আসিনি, আমার মাসির বাড়ি এখানে, মা বলল একবার ঘুরে আয়, মাসির নাকি জ্বর হয়েছিল শুনেছে মা কার কাছ থেকে... আমি এই লোকাল ট্রেনে লেবু লজেন্স বিক্রি করি… এ মা! এখানে কার টাকা রাখা.. পাঁচ টাকা.. দেখো…

ফাগু দেখল। বলল, কে ফেলে গেছে। তুই নিতে পারিস।

ছেলেটা জিভ কেটে বলল, হুস.. কার না কার টাকা… তুমি কি এই গ্রামেই থাকো?…

ফাগু মাথা নাড়ল। বলল, সকাল থেকে খেয়েছিস কিছু?

ছেলেটা মাথা নেড়ে হাসল। ফাগুর কষ্ট হল। তার মেয়েটার মত বয়েস। ফাগু বলল, বাবা নেই না? নাম কি তোর?

ছেলেটা বলল, আমার নাম জগন্নাথ সামন্ত। বাবা নেই গো। আমি ছোটো থাকতেই মারা গেছে। আমি, মা আর পিসি থাকি।

ফাগু বলল, তোর মাসির নাম কি?

ফাগু নামটা শুনে দমে গেল। কাল রাতেই মারা গেছে সে। টাইফয়েড হয়েছিল। ফাগু বলল, জগন্নাথ, তুই কি আমাদের বাড়ি হয়ে মাসির বাড়ি যাবি? একসঙ্গে খেয়ে তোকে তোর মাসির বাড়ি দিয়ে আসবখন। যাবি? তবে আমি কিন্তু মুসলমান…

জগন্নাথ লজ্জা পেল। বলল, এত বেলা হল, তোমার বাড়ি রান্না হয়ে গেছে না? তুমিও তো আর বড়লোক নও… আমি খেলে তোমার খাওয়ায় কম হবে… আমি বরং মাসির বাড়ি গিয়ে খেয়ে নেব…… মা বলে মাসির রান্নার হাত নাকি দারুণ… জ্বর হয়েছিল.. অ্যাদ্দিনে নিশ্চয়ই সেরে গেছে…

ফাগু বলল, বুঝেছি… আমি মুসলমান বলে…

জগন্নাথ তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আরে তা না গো… খিদের আবার হিন্দু মুসলমান হয় নাকি? এই যে চাল কিনি আমরা বাজার থেকে, সে চাল হিন্দু না মুসলমান চাষ করেছে জানি? ওসব ছোটো কথা….. বোকা লোকদের কথা… আমরা গরীব, আমাদের এটাই জাত… এসব মা বলে, আমি শুনি… আমার পিসির মাথা ফেটে গেছিল.. রক্ত লেগেছিল দু বোতল… এবি পজিটিভ… তখন এক ডাক্তার মাকে বলেছিল.. দেখো গো রক্তের গ্রুপ হয়, জাতধর্ম হয় না… আসলে আমার মা আগে একটু এসব মানত তো… পিসি মরে যাবে দেখে তো সে নিজেই মরে যাচ্ছিল, পিসি মায়ের প্রাণ আমার… তো পিসি বাঁচল.. মা-ও ওসব বলা ছাড়ল… এখন অন্য কথা বলে…

ফাগু উঠে জগন্নাথের হাত ধরে বলল, তবে চল আজ আমার বাড়িই খাবি… না হয় আধপেটাই খাব বাবা ছেলেতে… তোর একটা বোনও আছে… দেখবি… সে আবার কথা বলতে পারে না… কানেও শোনে না….

জগন্নাথের চোখে জল এলো। ফাগুর হাতটা ছাড়ালো না। বলল, চলো।

ফাগু আর জগন্নাথ রোদের মধ্যে হাঁটা লাগালো। ফাগু শক্ত করে ধরে আছে জগন্নাথের ছোটো কোমল হাতটা। এত কোমল হাত, কি করে এই কঠিন সংসারে একা এসে পড়ে… কেন হাত ছেড়ে যায় আব্বু?

আব্বু হাসল। ফাগু শুনল। আব্বু বলল, হাত কঠিন হবে, প্রাণ কোমল থাকুক ফাগু। কোমল প্রাণই মালিকের গলা চেনে… কঠিন প্রাণ কালা হয়.... যেমন তার মেয়ে শোনে... মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি ভাবে... চোখের কোল নরম জলে ভরে যায়... ফাগু দেখেছে... বুকের ভিতরে একটা নদী আছে... সে নদীর উৎস জানে না কেউ... মেয়েটা সে নদীর খোঁজ পেয়েছে... ফাগু জানে.. আব্বু বলেছে..

ফাগুর চোখ ঝাপসা হল।

মন্দিরের বারান্দায় রাখা কঠিন ধাতুতে গড়া পয়সায় জগন্নাথ আর ফাগুর ঘাম লেগে। বাতাস এসে ঘামের গন্ধ মিলিয়ে দিল ধীরে ধীরে। পয়সা অপেক্ষা করল অচেনা কারোর, যে অজানা নয়। যাকে আল্লাহ রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে আসবে এখানে। ফাগুর ভালোবাসার কাছে। ভালোবাসার রাস্তা আল্লাহ ছাড়া আর কে দেখাবে? আব্বু বলে লালনের সুরে। ফাগু মজে।