Skip to main content



-----
মুকুন্দ চায়ের দোকানে বসে চায়ে নুন মেশাচ্ছে। এরকম মুকুন্দ প্রায়ই করে। বিশেষ করে রেগে গেলে বা মন খারাপ থাকলে।


     মুকুন্দ তবলা শেখায়। শ্যামনগরের একটা গ্রামেই তার বাড়ি আর বাড়িতেই স্কুল। 'আসুন তবলা বাজাই' - তার স্কুলের নাম। তার বয়স পঁয়ত্রিশ কি ছত্রিশ হবে। খুব লাজুক প্রকৃতির ছেলে।
বাবা আছেন। তাঁর মুদির দোকান। কার্তিকবাবু। খুব কম কথা বলেন। বিশেষ করে চুনিবালাদেবীর মারা যাওয়ার পর থেকে। এদিকে মুকুন্দও বিয়ে থা করেনি। ওনার আর সংসার ভালই লাগে না। মাঝে মাঝেই ভাবেন কাশী চলে যাবেন। স্টেশান অবধি গিয়েও ফিরে এসেছেন হতভাগা মুকুন্দটার জন্য। ভাবেন, "যা হোক যে কদিন বাঁচি ছেলেটার সাথেই কাটাই, একটু যদি বিষয়বুদ্ধি থাকত ব্যাটার!"
     আজ সকাল থেকেই মুকুন্দের মন খারাপ। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তরও দিচ্ছে না ঠিক করে। মদনের চায়ের দোকানে এসে এক কাপ চিনি ছাড়া চা চাইল। তখনই মদন বুঝেছে, এইবার পকেট থেকে নুন বার করে মেশাবে চায়ে।
     হলও তাই। মদন প্রায় মুকুন্দের সমবয়সী। সে বললে, "কি হয়েছে রে মুকুন্দ, বাবার সাথে ঝামেলা করেছিস?"
     মুকুন্দ মাথা নাড়ল।
     "তবে?", দোকানটা একটু ফাঁকাই ছিল, মুকুন্দের পাশে এসে বসল মদন।
     "কি জানি, কিচ্ছু ভাল লাগেনা আজকাল।", এই বলে সে নুন মেশানো চায়ে চুমুক দিল। আগে মদনের গা গুলিয়ে উঠত এই দৃশ্য দেখলে। এখন আর গুলায় না। অভ্যাস হয়ে গেছে।
"বিয়ে থাওয়াও করলি না। খারাপ তো লাগবেই। এত বড় জীবন একা একা কাটানো যায়।", দীর্ঘশ্বাস ফেলল মদন। তার বউটা বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেছে বছর দশ হল। মদন আর বিয়ে করে নি। তার মেয়ে পাশের গ্রামেই তার মামাবাড়িতে মানুষ হচ্ছে। সে দু'দিন অন্তর গিয়ে দেখে আসে।
     কি একটা ভেবে হঠাৎ সে বলল, "একটা কথা শুনবি মুকুন্দ? না বলিস না কিন্তু।"
     মুকুন্দ মাথা নীচু করেই বলল, "বল, আগে শুনি।"
     "তুই একবার কান্তাদার কাছে যা। ভাল লাগবে দেখবি। আমার যখন ঘর পুড়ল তখন কান্তাদাই আমায় দাঁড় করালেন, তুই যা ভাই আজই বিকালে যা। বাড়ি চিনিস তো?", বলতে বলতে মদনের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
     মুকুন্দ নিরুত্তাপ গলায় বলল, "দেখি।"

 


---
কান্তাদাকে মুকুন্দ খুব ভাল করেই চেনে। কান্তাচার্য্যও মুকুন্দকে ভালভাবেই চেনেন। পাশের কয়েকটা পাড়া পরেই মুকুন্দের বাড়ি। পাড়ার সব ফাংশানে মুকুন্দই প্রধান তবলা বাদক থাকে প্রায়, খুব ভাল ছেলে। কান্তাবাবু বেশ স্নেহই করেন মুকুন্দকে।

      তবে হঠাৎ সাত-সক্কালে মুকুন্দকে দেখে বেশ অবাক হয়েছেন তিনি।
     রবিবার। সকাল আটটা হবে। তিনি কাগজে একটা কোষ্টকাঠিন্যের বিজ্ঞাপন পড়ছিলেন মন দিয়ে। কয়েকদিন ধরেই খুব সমস্যা হচ্ছে সকাল হলেই। ইয়ে করতে যাওয়ার আগে তাঁর মুখটা, অঙ্ক পরীক্ষার দিন পটলার যেরকম মুখের গতি হয় সেরকম হয়ে যায় আজকাল।
     যা হোক মুকুন্দ আসল। তিনি বললেন, "হ্যাঁ রে কাকাবাবু ঠিক আছেন তো রে?"
     মুকুন্দ বলল, "হ্যাঁ দাদা, বাবা ঠিক আছেন। আসলে আমি এসেছি আমার নিজেরই জন্য।"
    মুকুন্দর হঠাৎ কিরকম লজ্জা লাগতে শুরু করল। মনে হল, ইস্, এইসব কারণের জন্য কাউকে বিরক্ত করা। না, মদনের কথায় নাচাটা তার ঠিক হয়নি। রাগ লাগতে লাগল নিজের ওপর। কি বলবে সে এখন কান্তাদাকে? 'আমার মন ভাল যাচ্ছে না বলে আপনার কাছে এলুম' - ছি ছি! উনি কি ভাববেন!
    কান্তাচার্য্য মুকুন্দের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। ওর ইতস্তত ভাব দেখে কিছু বুঝলেন। তারপর বললেন, "চলো মুকুন্দ বাগানে হেঁটে আসি একটু।"
মুকুন্দ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল, "চলুন।"

 



---
"কান্তাদা আমার বেশ কিছু মাস হল কিছুই ভাল লাগছে না। তবলা শেখাতে না, গান শুনতে না, কারোর সাথে কথা বলতে না, কিচ্ছু না। লোকে ভাবছে আমি বিয়ের জন্য এরকম করছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন আদৌ তা না। আমার কেন ভাল লাগছে না আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারছি না", কথাগুলো প্রায় এক নিশ্বাসে বলে গেল মুকুন্দ।

     বেশ বড় বাগান। কয়েকটা আমগাছ, পেয়ারাগাছ আর অনেকগুলো নারকেল আর সুপুরি গাছ আছে। কান্তাবাবুর স্ত্রী কয়েকটা ফুলগাছ লাগিয়েছেন পূজোর জন্যে - জবা অনেকরকম, নয়নতারা, টগর। মার্চের মাঝামাঝি, তবু খুব গরম পড়েনি এবছর এখনো। বেশ ভালই লাগছে হাঁটতে কান্তাবাবুর।
      তিনি মন দিয়ে সব শুনছিলেন। মাঝে মাঝে খেয়ালও করছিলেন মুকুন্দকে।
    হ্যাঁ, ছেলেটার মুখে একটা ছাপ পড়েছে বটে ওর মনের। চোখের তলায় কালি, যদিও ভালভাবে না দেখলে বোঝা যাবে না। মুখের মধ্যে একটা অস্থির ভাব।
     "তোমার কিছু কি মনে হয়? যেমন ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা, বা কোনো সুপ্ত বাসনা অপূর্ণ থাকার ক্ষোভ, বা কোনো খারাপ ব্যবহার খুব কাছের কোনো মানুষের থেকে?" কান্তাবাবু দাঁড়িয়ে পড়ে, মুকুন্দের চোখের দিকে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলেন।
     মুকুন্দ অস্বস্তিতে পড়ল। তার উচ্চাকাঙ্খা যে ছিল না তা তো না। তাকে দেখতে ভাল ছোটবেলা থেকেই, তাই সাধ ছিল সিনেমায় অভিনয় করার। আর একটা সাধ ছিল পাইলট হওয়ার। তা দুটোই উচ্চাকাঙ্খাই বটে। বিশেষ করে পরেরটা। কিন্তু পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল না সে। মাথা পরিস্কার ছিল না। না পারত ইতিহাস মুখস্থ রাখতে না পারত অঙ্ক কষতে ঠিক মত। ভাগ্যিস তবলাটায় তার খুব আগ্রহ ছিল বরাবর, তাই আজ করে খেতে পারছে কিছু!
     তবে কি তার উচ্চাকাঙ্খাটাই এর মূল কারণ? না, তা কি করে হবে? সে পাট তো চুকিয়েই দিয়েছে কবে। ভাল দেখতে হলে কি হবে, সংলাপ মুখস্থই রাখতে পারত না সে। অন্যের সংলাপ নিজেই বলে স্টেজে প্রায় কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিয়েছিল দু'বার। ক্লাবের ছেলেরা এই মারে তো সেই মারে! তারপর থেকে সে অভিনয়ের কথা তো আর ভাবে নি!
     আর পাইলট? তার যা অঙ্কে মাথা, সে প্লেন চালালে সোজা বৈকুণ্ঠে গিয়ে ল্যান্ড করত।
না:। এসব না। এসব তো সে কবেই মেনে নিয়েছে। তবে মনের গভীরে আরো কিছু বাসা বেঁধে আছে?
     মুকুন্দের সব গুলিয়ে যেতে লাগল। মনে হল মনের তলানিটাকে ধরে নাড়িয়ে দিলেন কান্তাবাবু। কিসব খেয়াল আসছে তার। লোকের ঠাট্টা, ইয়ার্কি তাকে নিয়ে।
     স্টুডেন্টদের বাড়ির লোকেরা বড্ড ছোট করে দেখে তাকে - "মাস্টারমশায় আপনার কাছে ও আর আসবে না সামনের দু'বছর, মাধ্যমিক তো, বুঝতেই পারছেন।" বা কেউ বলল, 'উচ্চমাধ্যমিক তো সামনে!', আবার কেউ বলল, 'আপনার ডেটটা পাল্টাতে হবে স্যার, ওর অঙ্কের স্যার ওই সময়টাতেই আসবেন বলছেন। আগের সময়টা উনি ওনার মেয়েকে সাঁতার শেখাতে নিয়ে যাবেন।'
       কেউ ছেলেকে ক্রিকেট শেখাতে নিয়ে যাবেন, তো কেউ এক্সট্রা কোচিং ক্লাসে।
    আর সব জায়গায় কে ডেট অ্যাডজাস্ট করবে? না মুকুন্দ। সে যেন একটা ফালতু, এলেবেলে।
     রাগ লাগে, অপমান লাগে। কিছু বলতে পারে না। কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। তার কান্না পেতে লাগল। বুকের ভেতরটা হাঁচড় পাঁচড় করতে লাগল। কি করবে সে এখন? পালিয়ে যাবে? সেই ভাল। যদি সে কেঁদে ফেলে কান্তাদা আর কিছু বললে? না না এই বেলা চলে যাওয়াই ভাল।
সে তড়িঘড়ি করে বলল, "কান্তাদা পরে আসব। কয়েকদিন একটু ভেবে নি যা বললেন। পরে আসব।"
     বলেই কান্তাচার্য্যকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল মুকুন্দ।
কান্তাচার্য্য কিছু আন্দাজ করেই আর আটকালেন না মুকুন্দকে।

 



---
মুকুন্দ উত্তর পেয়ে গেছে। কান্তাচার্য্য বুঝতে পেরেছেন। সে আর আসবে না। কিন্তু এই সহজ কথাটা সে বুঝতে পারছিল না কেন? নিজেকে স্বীকার করলেই তো সব ঝামেলা চুকে যায়, সেই গুরুদেবের কথা, "ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে", কিন্তু এই সহজ কথাটা বুঝতে পারে না কেন মানুষ!

     কান্তাচার্য্যের মাথা কেমন করতে লাগল। গা ভারী হয়ে আসল। তিনি বুঝলেন তাঁকে একা থাকতে হবে এখন।
      তিনি ছাদে উঠলেন। নীচে বলে গেলেন কেউ যেন তাঁকে না ডাকে।
     তিনি ভেবেই চলেছেন, এই সহজ কথাটা বোঝার জন্য মুকুন্দকে তাঁর কাছে আসতে হল কেন? মুকুন্দের চোখে তিনি জল দেখেছেন। আনন্দাশ্রু? মানুষ যখন কোনো গভীর সত্য অনুভব করে তার চোখে জল আসে। আসতেই হবে, সে সত্য দুঃখের হোক চাই সুখের। তাই সত্যকে উপলব্ধি করলেই আসে আনন্দ। সত্যের চেতনার আনন্দ। যাঁকে আরো গভীরে গিয়ে উপনিষদ বলেন, 'সৎ-চিৎ-আনন্দ' বা 'সচ্চিদানন্দ'।
     বেলা গড়িয়ে বিকাল হল। কান্তাচার্য্য নীচে নামেননি। এক পটলা ছাড়া কেউ খায়নি বাড়িতে। বিকেলবেলা তারাসুন্দরীদেবী এসে বললেন, "হ্যাঁ গো সময় যে বয়ে গেল, কিচ্ছুটি মুখে কাটনি সকাল থেকে, কিছু খেয়ে নাও।"
     কান্তাচার্য্য চমকে উঠে তাকালেন তারাদেবীর দিকে। বললেন, "কি বললে গিন্নী, কি বললে! আবার বলো!"
    তারাদেবী অবাক হয়ে বললেন, "কি আবার বললুম। বলছিলাম সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, খাবে কখন, এরপর পিত্তি পড়বে যে....."
     আরো কি বলে যাচ্ছিলেন তারাদেবী। কান্তাচার্য্যের কানে কিছু আসছিল না।
     
     তিনি বুঝেছেন!
    মানুষ যেটা বোঝে, সেটার দিন-ক্ষণ, আকার-বিকার সব বলতে পারে। কবে পূর্ণিমা, কখন জোয়ার ভাঁটা, কবে কোন ধূমকেতু আসবে সব সে বলতে পারে। কারণ সে বুঝেছে এগুলো। কিন্তু সে কখনো বলতে পারে না, কখন সে বুঝবে। কেউ বলতে পারে না। কোনো বিজ্ঞানী বলতে পারেন না, তিনি কখন বুঝবেন তাঁর তত্ত্ব। সহজ বা কঠিন যাই হোক না কেন, মানুষ কোনো দিন বলতে পারবে না সে কখন কোনো জিনিস বুঝবে বা উপলব্ধি করবে। কারোর গায়ের জোর খাটবে না। না- না- না, কারোর জোর না, কারোর না। এটা যাঁর হাতে তাঁরই হাতে।
   তাঁর দু'চোখ জলে ভরে আসল। তিনি তারাদেবীকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। আর বলতে লাগলেন, "বুঝেছি গিন্নী বুঝেছি, সময় না হলে কেউ বুঝবে না, কেউ না"।
    তারাদেবীও কাঁদলেন। কেন কাঁদলেন তিনি জানেন না। হয়তো তাঁর সেটা বোঝার সময় হয়নি এখনো।
     বিকালের পড়ন্ত আলো তাঁদের অশ্রুতে প্রতিবিম্বিত হতে থাকল। আনন্দাশ্রুতে।