গোঁসাই বলল, দেখ, মহাপ্রভু পেয়েছিলেন ডেকে, রামকৃষ্ণদেব পেয়েছেন কেঁদে। উনি তাই বলতেন না, কাঁদতে পারো? লোকে মাগ ছেলের জন্যে ঘটি ঘটি কাঁদছে। ঈশ্বরের জন্য, ভগবানের জন্য আর কে কাঁদছে বলো?
গোঁসাই বলে চলল, ঠাকুরকে যে ঠিক ঠিক ডেকেছে, ঠাকুর তাকে কাঁদিয়েছেন।
চমকে উঠে বললাম, একি বলো গোঁসাই… এ তো ভয়ের কথা….
গোঁসাই বলল, ছেলে যে মায়ের জন্যে কাঁদে… সেকি ভয়ের কথা? সেকি ভাষা জানে, না ভাব জানে? সে ব্যথা জানে। ব্যথাকে কান্নায় বাইরে আনে। মা সাড়া দেয়। জীব দুর্বল। বিচার করতে গেলে গুলিয়ে যায়। দাঁড়াতে গেলে পড়ে যায়। চলতে গেলে হারিয়ে যায়। তাই ঠাকুর নিদান দিলেন কাঁদতে পারো?
কান্না তো দুর্বলের….
গোঁসাই বলল, কান্না দুটো হয়। দুর্বলের পাঁকে পড়ে যাওয়ার কান্না। সে শোকের কান্না। আর পাঁক থেকে উঠতে না পারার অসহায়তার কান্না। ঠাকুর দ্বিতীয়টার কথা বলছেন। সেখানে কান্নাই বল। কান্নাই গুরু। ঠাকুর তাই টেনে টেনে বলছেন না, আন্তরিক হলে তিনি শুনবেনই… এ..ক..শো…বার শুনবেন।
গোঁসাই কীর্তনে গেল। আমার ফেরার তাড়া। কিন্তু মাথায় থেকে গেল একটাই কথা… ঠাকুরকে যে ঠিক ঠিক ডেকেছে তাকেই ঠাকুর কাঁদিয়েছেন….রাস্তা হারানোর কান্নায় থাকে রাস্তা পাওয়ার আকুতি….সেই কান্না না জাগলে সত্যিই তো সব আলুনি… সব একঘেয়ে…
ট্রেনে ভিড়। ভিড়ের মধ্যে শুনছি দীর্ঘশ্বাস। লক্ষ মানুষের লক্ষকোটি শোক, হতাশা, ব্যথা। গুমোট হয়ে আছে বুক। অভিমানে। এত অভিমান! কেন মন, কেন? সব ভোলো মানুষ.. সব ভোলো। অর্জুনও যে তীব্র আলো সহ্য করতে না পেরে কেঁদে পড়েছিল… বলেছিল মানুষ হয়ে দাঁড়াও কৃষ্ণ আমার সামনে… এ বিশ্বরূপ আড়াল করো… আমি সহ্য করতে পারছি না….সেকি আমি তুমি সহ্য করতে পারি? অর্জুন মানুষকে চাইছেন। সোনার মানুষ। মনের মানুষ। অলীক মানুষ। এ মানুষে যে মানুষ আছে, সে মানুষের ছাঁচকে ফেলে কি নিয়ে খেলো মন? যার ভালোবোধে সব ভালোকে চেনো… সেই যে গো ভালো মানুষের ছাঁচ… সে ছাঁচে যে মাধুর্য… তাকেই চাই… মানুষে ডুবে মানুষের মাধুর্যকে চাই। ভোগে ডুবলে সে কাম। প্রেমে ডুবলে সে গোবিন্দ। প্রতি চোখে গোবিন্দ। প্রতি হাত পায়ে গোবিন্দ। "ব্রহ্ম হতে কীটপরমাণু সর্বভূতে সেই প্রেমময়/ মন প্রাণ শরীর অর্পণ করো সখে এ সবার পায়/ বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর/ জীবে প্রেম করে যেই জন/ সেই জন সেবিছে ঈশ্বর"।