তো এদিকে তো কী সব বণ্ডে কে কাকে কত টাকা দিয়েছে সেই নিয়ে হুজ্জতি চলছে। এমনিতেই আমি অঙ্কে ভীষণ কাঁচা, শাকের টাকা মাছে গিয়ে পড়ে, মাছের টাকা শাকে, তায় এত কোটি কোটি টাকা। যা হোক, যে নিয়েছে আর যে দিয়েছে তাদের মধ্যে কোনো সমস্যা না থাকলে আমি আর কী করতে পারি এসব ভেবে-টেবে।
এই মানসিক অবস্থার মধ্যে খবর পেলাম কমলেশ্বরবাবু নাকি সেই রবিনসন স্ট্রিটের কঙ্কাল কেস নিয়ে তথ্যচিত্র করেছেন আর সেটা নাকি ওটিটিতে চলছে। সেই যে গো পার্থ, দেবযানী। দেবযানীর কঙ্কাল নিয়ে পার্থ আর ওর বাবা দীর্ঘদিন ধরে এক বাড়িতেই ছিলেন। তারপর ভদ্রলোক গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন। পার্থকে পুলিশে নিয়ে যায়, মনোরোগের চিকিৎসা হয়, মাদার্স হাউজে যায়, তারপর আত্মহত্যা করে, সেও গায়ে আগুন দিয়েই।
তখন তো রোজ রোজ এই খবর ছাপা হচ্ছে বাংলা, ইংরেজি দুই কাগজেই। বাংলায় তো দারুণ রসিয়ে রসিয়ে লেখা হচ্ছে, জল্পনা-কল্পনা চলছে ইত্যাদি। তো এমন একটা বিষয় নিয়ে একজন বুদ্ধিজীবী মানুষ তথ্যচিত্র বানালে দেখার সাধ যায় না? আমার তো যায়। 'তথ্যচিত্র' কথাটা দেখুন আমি বলিনি, ওই ‘ওটিটি’ প্ল্যাটফর্ম বলেছে।
আজকাল নেটফ্লিক্সে একটা দারুণ কায়দায় তথ্যচিত্র হয় না? আগে তো সাহেব-সুবোরা কায়দাটা পারতো, আজকাল দেখি মুম্বাইয়ের লোকেরাও শিখে গেছে কায়দাটা। আরে ওই যে গো, একজন চেয়ারে বসে থাকবে, তাকে কে প্রশ্ন করছে, আর কী প্রশ্ন করছে দেখা যাবে না, কিন্তু সে বলেই যাবে। আবার আরেকজন বলবে। ব্যাকগ্রাউন্ডটা কালো কালো থাকবে। আর যারা সব বলবে তারা কী সব গণ্যমান্য ব্যক্তি বাবা! এরকম তথ্যচিত্র সে আলেকজান্ডার হোক, কি শিনা বোরা কেসের ইন্দ্রাণী মুখার্জি হোক, সব এক কায়দায়। আমার বেশ লাগে।
তো আপাতত এই আলোচ্য তথ্যচিত্রটাও তেমনভাবে শুরু হল। কিন্তু বলব কী মশায়, সে কী আশ্চর্য কাণ্ড!
দেবযানী কঙ্কাল হয়ে শুয়ে, ক্যামেরা ঢুকছে স্লো..লি, ব্যাকগাউন্ডে কী গান হচ্ছে জানেন? “চিরসখা ছেড়ো না মোরে”। মায় নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। এরকম অসামান্য প্রয়োগ সত্যজিৎ, ঋত্বিক, কুরোসাওয়া, গোদার, বার্তলুচি..মার্টিন স্করসেসি..স্করসেস..স্করেসেসিসসসস…যা হোক উনিই আরকি, ভাবতে পারতেন!
শুধু কী তাই গা? দেবযানীর কঙ্কালের কাছে ক্লোজ আপ শট। ব্যাকগ্রাউণ্ডে গান হচ্ছে, “ঘোরা রজনী এ মোহঘনঘটা”। উফ! উফ! উফ! আমার সারা গা রোমাঞ্চিত হচ্ছিল দেখতে দেখতে।
তারপর যখনই পার্থর জটিল মনোব্যথা, মনোব্যধি, মনোগড়বড় বোঝাতে চাইছেন পরিচালক, সঙ্গে সঙ্গে জীবনানন্দের লাইন। আহা! পার্থ মনোবিদকে একা ঘরে পেয়ে শাড়ি খুলতে বলছেন, তার পুরুষাঙ্গ দাঁড়ায় কিনা নিয়ে মনোবিদেরা কত কথা বলছেন, তার মা নাকি তার ঘরে পরিচারিকাকে পাঠাচ্ছেন, তারপর নাকি তার দিদির সঙ্গে তার যৌন সম্পর্ক থাকার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে…আর এই সব দৃশ্য, সেই বুদ্ধিজীবী পরিচালক দেখাতে দেখাতে কী সব অসামান্য কবিতার লাইন ব্যবহার করছেন। চুল তার কবেকার….থাক থাক।
তারপর তো মনোবিদদের ভিড়। সেখানেও অসামান্য এডিটিং। একজনের বক্তব্য গোটা হতে না হতেই আরেকজনের বক্তব্য, তায় কবিতা, তায় গান, তার মুরগীকাটার দৃশ্য, তায় জীবনানন্দ, তায় পার্থর বাবার আধপোড়া মুখ, তায় অস্কারনিন্দিত অভিনয়..তায় টপ্পাঙ্গের রবীন্দ্রসঙ্গীত..… বিশ্বাস করুন আমার কতবার যে মনে হল দেওয়ালে ছুঁড়ে মারি আমার দেখার যন্ত্রটা সে আমি বলেও বোঝাতে পারব না। মারলাম না। নেহাৎ কিছু শুভ কর্ম গত জীবনে ছিল বলেই নিশ্চয়। আমার না, যন্ত্রটার।
তথ্যচিত্রটা দেখার পর থেকে আমার ঘুম কমে গেছে, খাবারদাবার ঠিক হজম হচ্ছে না, থেকে থেকেই মনে হচ্ছে কে যেন ঘাড়ে, মাথায়, পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, কে? জীবনানন্দ, না রবীন্দ্রনাথ? না পার্থ, না কমলেশ্বরবাবু আপনি? এভাবে আমায় নিয়ে ছেলেখেলা করবেন না আপনারা প্লিজ। “আমারও তো মন আছে কেন বোঝো না”.... না এই গানটা নেই। থাকতেও পারত, কিন্তু নেই। আবার এও জানলাম মস্তিষ্ক বলতে নাকি মাত্র চারটে লোব। বাকি মধ্য আর লঘু কোথায় গেল বুঝলাম না। বায়োলজি বইটা খুলতেই জীবনানন্দ ছোঁ মেরে বই কেড়ে নিয়ে বললেন, “হৃদয় ছায়ার সাথে চালাকি করেছে”।
এদ্দিন জানতুম তথ্যচিত্র বানাতে গেলে তা অবজেক্টিভ হতে হয়, ফ্যাকচুয়াল হতে হয়। তার সঙ্গে যে এমনি….
আচ্ছা জীবনানন্দ দাশের মস্তিষ্কের সঙ্গে কি পার্থের মস্তিষ্কের মিল দেখাতে চেয়েছিলেন পরিচালক? নইলে পার্থের হৃদয়ের কথা বোঝাতে শুধু জীবনানন্দ কেন? অবশ্য হতেই পারে। বলি হ্যাঁ গা, তথ্যচিত্রেও হতে পারে?
তথ্যচিত্র চলছে। গান হচ্ছে, “আরো আঘাত সইবে আমার”.....
না, সইবে না। সইছে না। পার্থর কী কী মনোরোগ ছিল না জানি না, কিন্তু আমাদের গোটা জাতটার কি সবার OCD? জীবনানন্দ, আর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে? অনুরাগ কাশ্যপ কি যেন বলেছিলেন। কি যেন?.... হিমালয় থেকে না কোত্থকে পড়েছে যেন….আকাট মুখ্যু একটা, কিস্যু বোঝে না…..
কেহ কারো মন বোঝে না….
না, এটা তথ্যচিত্রে নেই। ভাগ্যে এনারা নির্ভয়া বা অমন কাণ্ড নিয়ে তথ্যচিত্র বানাননি। তবে বাংলা সাহিত্যের কী গান, আর কী কবিতা যে ব্যবহার হত স্বয়ং ব্রহ্মাও জানেন না।
ইহাকে কী বলব? ট্র্যাভেস্টি? বা হিস্ট্রি? না হিস্টিরিয়া?