Skip to main content
 
 
        ভৈরবী ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারল বেলা হয়ে গেছে। এখন উঠেও কোনো লাভ নেই। গালাগালি শুনতেই হবে। গায়ের উপর লেপ্টে থাকা কম্বলটা ফেলে দিতে ইচ্ছা করছে না। আরকিছুক্ষণ থাক। কাল রাতে কম্বলের তলায়, ভিতরে... সে কাম... প্রেম? 
        ভৈরবী চোখ বন্ধ করে আবার শুলো। এই মাঘের মেলায় তারা প্রতি বছর আসে। তাদের মত অনেকেই আসে। নিজের মত অনেককে ভাবতে ভৈরবী ভালোবাসে না। সে একা। ঈশ্বরের একান্ত নিজস্ব সৃষ্টি। কাম জীবের ব্যবহার। তার নয়, তবু সে কেন? তার সাথে কেন? গ্লানির মধ্যে মনটা আড়ষ্ট, তাই বারবার মনে হচ্ছে আজ উঠবে না। উঠলেই সবার বাজে কথা। 
        রাতে তার ঘরে সেই সময় হঠাৎ ঢুকে পড়েছিল বিন্দু, এলাহাবাদের থেকে এসেছে। ভৈরবীর মনে পড়তেই লজ্জায় কানদুটো গরম হয়ে গেল। মুখও দেখবে না ভৈরবের। অনেক সাধিকার সাথে তার নষ্টামি। এতো আগে থেকেই জানত ভৈরবী, তবু কেন ওকে তার তাঁবুতে ঢুকতে দিল? কেন নিজের হাতে গাঁজা সেজে এনে দিল? শত্তুর, তার এই শরীরটাই তার শত্তুর। মাগী তোর পঞ্চাশ বছর বয়েস হতে চলল, এখনও এমন হাঘরের মত খিদে কেন? 
        ভৈরবীর বিয়ে হয়েছিল। সংসার হয়নি। তাঁবুর চারদিকটা আলো হয়ে গেছে। কীর্তনের আওয়াজ আসছে। মন্ত্রপাঠের শব্দ আসছে। ভৈরবীর সমস্ত শরীর জুড়ে আচ্ছন্নতা। তার ঈশ্বরের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশ্বরের চোখদুটো খোলা। তার দিকে তাকিয়ে স্থির দৃষ্টিতে। ঈশ্বর তার শরীরটা দেখছেন, নগ্নতাকে আড়াল কি ঈশ্বরের সামনে করা যায়? ঈশ্বর প্রতিটা বিন্দু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। করুণাজ্যোতি ঝরে ঝরে পড়ছে তাঁর চোখের দৃষ্টিতে। ভৈরবীর শ্বাস রুদ্ধ। এমন স্পষ্ট করে তাঁর ইষ্টদর্শন হয়নি তো আগে। কি অপূর্ব, কি অদ্ভুত, কি আনন্দ। ভৈরবী করজোড়ে তার প্রাণের সমস্ত আকুতি, তৃষ্ণা, ভক্তি উজাড় করে অঞ্জলি দিল। চোখের জলে খড়ের বিছানা ভিজল। কম্বলের খুঁট দিয়ে চোখের কোনা মুছতে গিয়ে আবার ভৈরবের গায়ের গন্ধ পেল। আড়চোখে ইষ্টের দিকে আবার তাকালো, তাঁর প্রসন্নমুখে কোনো বিকার নেই তো! 
        ভৈরবীর উঠতে ইচ্ছা করছে না। সমস্ত কম্বলটা তার অবিন্যস্ত কাপড়ের উপর দিয়ে জড়িয়ে, বুকের সাথে মিশিয়ে নিতে লাগল। তার ইষ্ট, তার ভৈরব, তার শরীর, তার আত্মা - সব মিলে মিশে এক হয়ে গেছে আজ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। আজ আনন্দ যেন পাকা ফুটির মত ফেটে পড়েছে তার বুকের মধ্যে। তার বুকটা তরমুজের মত লাল। 
        হঠাৎ বিন্দু ঢুকল হুড়মুড় করে। দিদি আপনি এখনও শুয়ে... ওদিকে সব্বনাশ হয়ে গেছে...
        ভৈরবী ধড়মড় করে উঠে বসে বিন্দুর মুখের দিকে তাকালো। তার বুকটা বিন্দুর মুখ দেখে কুঁকড়ে গেল ভয়ে মুহূর্তেই... অস্ফুটে বলল, কি হয়েছে রে বিন্দু... বিন্দু গতকালের রাতের কাপড়টাই পরে... স্নান করেনি এখনও?... কেন? 
        ভৈরবকে রাতে সাপে কেটেছে। তার তাঁবুর মধ্যেই মরে পড়েছিল...
        ভৈরবী স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। সদ্য মৃত সুখের শবদেহটার দিকে তাকালো। তার বুকের রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে। নিজেকে কি ভীষণ নিষ্ঠুর মনে হল, ভৈরবী কাঁদো... কাঁদো... বিয়ের রাতে মদ্যপ স্বামীর মুখটা মনে পড়ল। সারাটা শরীর ব্যথা করছে। গা গুলাচ্ছে কম্বলের গন্ধে। সে জিজ্ঞাসা করল, শ্মশানে নিয়ে গেছে?
        না, তুমি আসবে?
        চল
        ভৈরবী যেতে যেতে মন্দিরের দিকে তাকালো। একজন নিঃসঙ্গ পাথরের পুরুষকে দেখল। করুণা হল।