Skip to main content
 
 
       টিটি নিজেই জিজ্ঞাসা করল, এই বার্থটা কি ফাঁকা যাচ্ছে? আসলে একটা কুপে ছটা বার্থই আমাদের বুক করা ছিল। কিন্তু শেষ সময়ে আমাদের এক বন্ধুর অফিসে ছুটি নিয়ে ঝামেলা হওয়াতে সে গেল না। স্লিপার কোচ, এস সিক্স। ওর আপার বার্থটা ছেড়ে দিলাম টিটিকে। চেন্নাই মেল, আমরা ভাইজ্যাক বেড়াতে যাচ্ছি। টিটি বলল, ঠিক আছে আমি কাউকে অ্যালট করে দেব। 
 
       যা হোক, কেউ তো পাবে বার্থটা, কিন্তু কথা হচ্ছে সে কেমন হবে। সাথে দামি ক্যামেরা ইত্যাদি সব আছে। কথা হল আমরা একজন একজন করে জেগে থাকার চেষ্টা করব। খাওয়া হাওড়া থেকে সেরেই উঠেছিলাম। সবাই অফিস থেকে সরাসরি এসেছে, স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ ক্লান্ত। শুয়ে পড়লাম। প্রদীপ্ত বলল ও জেগে আছে দুটো অবধি। আমি মিডিলে, প্রদীপ্ত ঠিক আমার বিপরীতের মিডিলেই। দেখলাম মোবাইলে কিছু একটা পড়ছে, আমি শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তি, তার সাথে বেড়াতে যাওয়ার উত্তেজনা। ডিসেম্বর মাস, কাঁচগুলো নামানো সব কোচের। দুলুনিতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। কখন ঘুম এসে গেল। হঠাৎ ঘুম ভাঙল, দেখি প্রদীপ্ত ঘুমাচ্ছে। ঘড়িতে একটা পঁচিশ। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, ট্রেন বেশ জোরেই চলছে। নামলাম বার্থ থেকে। লাগেজগুলো চেক করলাম। ঠিক আছে। একবার টয়েলেটে ঘুরে এসে জল খেয়ে বার্থে উঠতে যাব হঠাৎ খেয়াল করলাম আমাদের ফাঁকা বার্থটায় কেউ শুয়ে। কম্বলে আপাদমস্তক মুড়ি দেওয়া। এর মধ্যেই বার্থ অ্যালট করে দিল টিটি? খড়গপুরই তো এখনও আসেনি নিশ্চয়, ছাড়লই তো প্রায় বারোটা দশ নাগাদ হাওড়া থেকে। যা হোক। প্রচণ্ড শীত করছে, আমি বার্থে উঠে শুয়ে পড়লাম, খুবই চোখটা টানছে। 
       বড় জোড় কুড়ি মিনিট, আবার ঘুম ভাঙল। একটা অস্বস্তি নিয়েই ভাঙল। উপরের বার্থের দিকে তাকাতেই হাড় হিম হয়ে যাওয়ার জোগাড় আমার। একজন মাঝবয়েসী লোক, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সারাগায়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে জুলজুল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। একটু একটু দুলছে মাথাটা ট্রেনের দুলুনির সাথে। আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম। হাসল না লোকটা। একই ভাবে তাকিয়ে থাকল। মনে হল একবার আমার বার্থের নীচেই জয় শুয়ে আছে, ওকে ডাকি। তারপর মনে হল থাক, ডেকে কিই বা হবে। বরং আমি নিজেই সতর্ক থাকি। ঘুমের ভান করে, মাথাটা ঢাকা দিয়ে, চোখের কাছটা একটু ফাঁকা রেখে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ও আমার দিকেই তাকিয়ে। তবে মনে হচ্ছে না বুঝতে পারছে যে আমি ওকে নজরে রেখেছি। ট্রেনটা কোথাও একটা দাঁড়াল। বগির মধ্যে কোনো আওয়াজ নেই শুধু কয়েকজনের নাক ডাকার আওয়াজ ছাড়া। আমার কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। লোকটা একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। 
       একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা ছাড়ল। লোকটা দুবার ইশারা করে আমায় ডাকল, ওই... ওই। কিরকম হিসহিসানি গলার আওয়াজ। আমি উঠে বললাম, কি? লোকটা ইশারা করে কাছে ডাকল। বলল, এই ট্রেনটা উল্টে যাবে একটু পরে। আমি বুঝলাম বদ্ধ পাগল। তবে কি টিটি ওকে বার্থ দেয়নি, নিজেই এসে জুড়ে বসেছে। নিশ্চয়ই তাই হবে। এরকম এক খেপাকে কেন বেকার টিটি বার্থ দেবে? 
       ট্রেন বেশ জোরেই চলছে। এবার মনে হল, না কাউকে একটা ডাকা দরকার। এ পাগল নিয়ে সারারাত যাওয়া যায় নাকি? আমি জয়কে ডাকতে পিছনে ঘুরেছি, হঠাৎ আমার পিঠে একটা ঠাণ্ডা হাত এসে লাগল। আমি চমকে উঠে পিছন ফিরতেই দেখি লোকটা বার্থ থেকে নীচে নেমে এসে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে। সারা গায়ে কেমন একটা অ্যাসিড অ্যাসিড গন্ধ। কম্বলটা গায়ে জড়ানো। আমার কাছাকাছি এসে এক ঝটকায় কম্বলটা ঝাঁকুনি দিয়ে খুলে ফেলে দিয়ে বলল, দেখ। দুটো হাত কাটা। আমি কিছু বলার আগেই ঝড়ের বেগে আমাদের কুপ থেকে বেরিয়ে টয়লেটের দিকে চলে গেল। আমার কিরম মনে হল। আমি পিছু পিছু গিয়ে ওকে আর খুঁজে পেলাম না। ফিরে এসে দেখলাম কম্বলটা মাটিতে পড়ে। দুর্গন্ধ ছাড়ছে। নীচু হয়ে যেই কম্বলটা তুলতে গেছি, কম্বলটা নড়ে উঠল। কিছু বোঝার আগেই দুটো কাটা হাত কম্বল থেকে বেরিয়ে আমার গলাটা চেপে জড়িয়ে ধরল। আবছা মনে হল লোকটা যেন ওই আপার বার্থেই বসে। হাসছে। আমার শ্বাস আটকে আসছে। চোখে অন্ধকার দেখছি। সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে।
 
       জ্ঞান ফিরতে দেখি আমি লোয়ার বার্থে শুয়ে। আমার আশেপাশে সব বন্ধুরা তো আছেই, আরো অনেক লোক। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমায় ধরে উঠিয়ে বসালো আদিত্য।  সবার চোখেমুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছিল? 
 
       ওদের কথা অনুযায়ী জয় নাকি টয়লেটে উঠতে গিয়ে দেখে আমি কুপের মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছি। 
       আমি বললাম, কম্বল? 
       আদিত্য বলল, কম্বল?
       আমি চট করে উপরের বার্থের দিকে তাকালাম, বললাম, ওইখানে?
       প্রদীপ্ত লোয়ার বার্থে পা দিয়ে গলা উঁচিয়ে দেখে বলল, এ বাবা, এটা কার? কে এসেছিল? কেউ অ্যাটাক করেছিল তোকে... ডাকিসনি কেন... কে ছিল... টাকা... ক্যামেরা...
 
       সবাই যে যার জায়গায় শুতে চলে গেল। আমি বললাম আমাদের কুপে আলোটা জ্বলুক। আমরা সবাই বসে। এমন সময় টিটি এসে বলল, ইনি এই বার্থে অ্যালটেড। আমি চমকে তাকিয়ে দেখলাম আমাদেরই বয়েসী একটা ছেলে। পরে জেনেছিলাম চেন্নাইতে চাকরি করে। টিটি আমাদের চোখমুখ দেখে জিজ্ঞাসা করল কি হয়েছে? সবটা শুনে চোখমুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল ওনার। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, রাম রাম... জয় রামজিকি... ফিরসে সুরু হুয়া... উয়ো ইস ট্রেন কে নীচে... পর উয়ো বহুত সাল কি বাত হ্যায়... দোনো হাত ...