গোঁসাই বলল, দেখো, যে দীঘিতেই নামো, শরীর ভিজবে। কিন্তু মন ভরবে না। যদি একবার নিজের দীঘির সন্ধান পাও, হারিও না। এ দীঘি, সে দীঘির জলে নেমে শরীর ভিজিয়ে বেড়িও না। মন থেকে যাবে শুষ্ক। রিক্ত। একা।
বললাম, জানি। কিন্তু এ কি করে হয়?
গোঁসাই বলল, এ হয়। এ রহস্য গো। দেখো না যেমন প্রকৃতির নিয়মে সময়ে ফুল আসে গাছ ভরে, এও তেমন। ঠিক সময়ে, ঠিক মানুষটার চোখে চোখ পড়ে। মন বোঝার আগেই আত্মা বলে, এ আমার। একে আমি জন্মজন্মান্তর থেকে চিনি….. রবি বাউলের গানে শোনোনি…. "তোমারে হেরিয়া যেন জাগে স্মরণে তুমি চিরপুরাতন, চিরজীবনে"... এ দু’বার হয় না গো…
আমি বললাম, তবে মন মাঝে মাঝে..
সে আরেক রহস্য। ওই যে বললাম, ওতে কৌতুহল মেটে, সাময়িক দাবী মেটে, নতুন স্বাদের বান ডাকে… কিন্তু গভীরে যে, সে বলে, এ নয়… এ নয়..। গভীরের ভাষা চাপা দিতে সে তখন জোরে জোরে কথা বলে, জোরে জোরে চিন্তা করে, তর্ক করে। ক্রমাগত কথা বলে। শান্ত হতে ভয় পায়।
গোঁসাই এতক্ষণ দীঘির পাড়ে বসেছিল। এবার উঠল। উঠে বলল, চলো, চন্দন বেটে দেবে। আমার হাতটায় খুব ব্যথা। এসো। প্রভুকে সাজানোর সময় হল। আরতি অবধি থাকবে, না যাবে?
বললাম, যা বৃষ্টি। ভাবছি আরতি অবধি হয় তো থাকা হবে না।
গোঁসাই মন্দিরে ঢুকে বসল। ফুলগুলো প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে উপুড় করল। এবার মালা গাঁথবে। আমি চন্দন বাটতে বসলাম।
মনে মনে একটা সঙ্কোচ হচ্ছে। ইতস্তত লাগছে জিজ্ঞাসা করতে।
গোঁসাই বলল, চন্দন বাটায় হাতে ছন্দ নেই কেন গো… বলে ফেলো..
বললাম, এখানে? শ্রীবিগ্রহের সামনে?
গোঁসাই হাসল। বলল, তিনি সর্বত্র ভাই। আর ত্রিভুবন পতিও.. স্বর্গ, নরক, মর্ত্য সবই তো ওঁর। বলো।
বললাম, একজন যদি বোঝে, যার সঙ্গে সে বাঁধা পড়ে আছে সামাজিক নিয়মে, সে তার সে-ই মানুষ নয়। এমন সময় যদি সে আসে… যে তার মনের মানুষ…..
গোঁসাই ফিরে তাকালো। মালা গাঁথা থামল। বলল, বসন্তে বর্ষার মেঘের মত যদি এসে দাঁড়ায়? না ভরা বর্ষায় পলাশ ফুটে ওঠে কোনো গাছে… তাই বলছ তো?
বললাম, খানিকটা তাই। তবে সে এতো কাব্যিক নয়…
গোঁসাই বলল, কাব্য নয়… কলঙ্ক তো?
বললাম, হ্যাঁ। আমার চোখ ঝাপসা হল। কেন? মন এভাবে সামনে এসো না… কি নির্লজ্জ তুমি!
গোঁসাই খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, হৃদয়ের ভাবসমুদ্র গোবিন্দের হাতে। সেখানে সমাজ, আইন কিছুই নেই। ভালোবাসা যদি সব সময় সমাজের বিধিনিষেধের খাতে বইত তবে সমাজে এত পাপ জমত না। ভালোবাসা সমাজ, সংস্কার, বিধিনিষেধের বাইরে গিয়েও বাঁচতে জানে। কলঙ্ককে নিয়েও বাঁচতে জানে। অন্তর্যামীর চোখে সোজা চোখ যদি পড়ে, জগতের বাঁকা চোখের চোখ রাঙানিকে ভয় কি তখন?
কিন্তু সে কি ব্যভিচার নয়?
গোঁসাই বলল, নয়। ওই যে শুরুতে বললাম, নিজের দীঘির জলে আত্মা, মন জুড়ায়। অন্য দীঘিতে শুধু শরীর ভেজে। আর যদি বলো সমাজ, তবে বলব, সমাজ সামাজিক রীতিনীতির অধিকার দেয়, হৃদয়ের অধিকার সমাজ দেবে!? সে অধিকার একমাত্র গোবিন্দের হাতে! জয়দেব পড়োনি?
চন্দন বাটা হল। আজ ফিরব না। আশ্রমে ভক্ত আসেনি আজ বেশি। ভীষণ বৃষ্টি। আশেপাশে সব ঝাপসা।
আরতি শুরু হল। মাথায় গীতগোবিন্দ ঘুরে চলেছে। তোমার চোখদুটো টানছে। তোমার অস্তিত্বে আমার গোবিন্দের অস্তিত্ব এসে মিশছে। তোমার চোখের দিকে তাকালে যে ব্যথা, সে ব্যথা অসীমকে সসীমে অনুভবের ব্যথা। মাটির জল বুকে নিয়ে শিকড়েরও এই ব্যথা হয়। জীবন মানে ব্যথা। ভালোবাসা মানে ব্যথা। আজ সুখ মানেও ব্যথা। তুমি জানো না আমার সত্তা সবটুকু দিয়ে তোমাতে মিশে। গোবিন্দ জানে। আমি তোমার কথা গোবিন্দকে বলি। গোবিন্দের কথা তোমায় বলি। মানুষ জন্মসূত্রে যা পায়, সে একমাত্র তার পরমায়ু। আমার সে পরমায়ুর সবটুকু ক্ষণ তোমায় দিলাম। তোমাতে গোবিন্দে আমার ভেদ নেই আজ। পরম কখনও দুটো হয় না। পরম মুহূর্ত বলেও কিছু হয় না। ভালোবাসলে সব মুহূর্তই পরম। এক।
অনেক রাত। ঘুম আসছে না। বাইরে এলাম। বৃষ্টি ধরেছে। আকাশ পরিষ্কার। গোঁসাই এখনও জেগে! ওই তো আমগাছটার তলায়।
পাশে গিয়ে বসলাম। গোঁসাই বলল, দিনে রাতে এসে যে মিশেছে, তাকে তাড়িও না। সে পাপ হবে। পাপ সমাজে নেই, হৃদয়ে, সত্যকে অস্বীকার করায়।
এক আকাশ তারা ফিসফিস করে কানে কানে বলল, সত্যি, সত্যি, সত্যিই।