Skip to main content


ছেলেটা হোয়াটস অ্যাপ থেকে চোখ তুলে স্টেশানে তাকালো। অফিস থেকে ফেরার সময় রোজ এই সময়টা তার ওর সাথে কথা হয় ঘন্টাখানেক। মানে শিয়ালদহ থেকে পৌঁছাতে যতটা সময় লাগে আর কি।
স্টেশানের অন্ধকারে আলোতে তার নিজেকে দাঁড়ানো মনে হয়। আর কিছুটা দূরে ওকে। ওকে মানে, যে এখন ন'বছর হল তার স্ত্রী। প্রেমিকা ছিল চার বছর।

প্রেমে সমাজ ছিল না। তারা ছিল। বিয়ের পর তাদের সাথে যেন সমাজের সহবাস। এটা ওর আগে মনে হত না। ইদানীং মনে হচ্ছে।
তাদের বাচ্চাটার বয়েস সাত বছর।
যেটা বলছিলাম। স্টেশানের এই আলো আঁধারিতে তার নিজেকে দাঁড়ানো মনে হয়। আর কিছুটা দূরে ওকে। রোজ মনে হয় না। যেদিন খুব মন খারাপ থাকে সেদিন। মন খারাপের সাহস অনেক বেশি। সে অনেক বাজে কথা চিন্তা করতে পারে। অসভ্য কথাও।
ছেলেটা ট্রেনের মধ্যে দাঁড়িয়ে, বসে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকালো। অফিস ফেরৎ ঝিমানো মুরগী সব! আজ ছেলেটার মন বেশি খারাপ। তাই বেশি সাহস। ট্রেনে মহিলা কম। একটা বউ-এর পিঠের দিকে অনেকটা খোলা। সেদিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে একজন বয়স্ক, চুল কালো রঙ করা বুড়ো। ছেলেটা চার অক্ষরের খিস্তি দিল। মনে মনে।
ছেলেটার হাতে বাদামের প্যাকেট ছিল, মনে হল প্যাকেটের শেষের নুনটা ওর চোখে ছিটিয়ে দেয় আর বাকিটা দেয় ডলে ওখানে। অনেকের সাহস বেড়ে গেলে রাগ বেড়ে যায়।
ছেলেটার খুব রাগতে ইচ্ছা করছে। খুব। পাড়ার দোকানের বাচ্চুদার কথা মনে পড়ল, ওজনে ঠকাতো ছোটোবেলায়। তাদের কাজের মাসির কথা মনে পড়ল, টাকা চুরি করত। পাড়ার নেলোদা'র কথা মনে পড়ল, ওর ডিভোর্সি মাসির সাথে গল্প করতে আসত দুপুরবেলায়।
নাহ্, কারোর ওপর একটা জমাটি রাগ তৈরি করতে পারছে না। এই প্রচণ্ড রাগটাকে সে খুব উপভোগ করে। মনে মনে একটা কঠিন প্রতিপক্ষ তৈরি করে, তার সাথে উত্তাল বাকযুদ্ধ চালায়। কান গরম করা সব গালাগালি। ছোটবেলা থেকে যেগুলো শুনে আসছে। বলতে পারেনি ভয়ে। ভয়ে ঠিক না, লজ্জায়।
সামনের দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার পায়ের সাথে ইচ্ছা করে দু'বার পা ঠেকালো। সে লোকটা এমন ঝিমোচ্ছে যে টেরও পেল না। মনে মনে তাকেও একটা দিল। লোকটা বসতে চাইছে না কেন? বসতে চাইলেও তো মুখের ওপর একটা থাপ্পড়ের মত 'না' ছুঁড়ে মারা যায়। সব শালা.... দল। আবার একটা।
এখন এক এক সময় তার মনে হয় জীবনটা যেন শুধুই এক নাগাড়ে জেগে থাকা। কোনো ঘুম নেই, কোনো স্বপ্ন নেই। সব সময় শুধু কর্তব্য, কাজ। কঠিন বাস্তবটা যেন তার সব সুখগুলোকে নিংড়ে ছিবড়ে করে ছেড়ে দিচ্ছে। বেড়াতে গেলেও ঘুরে ফিরে সেই শালা এক ফিরিস্তির সাতকাহন। সবটাই যেন অভ্যেস। এমনকি ল্যাংটো হলেও আর আলাদা কিছু লাগে না। অভ্যাসবশে যা হওয়ার হয়ে যায়।
ছেলেটা মহিলাটার খোলা পিঠের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণের জন্য মনটা ফাঁকা হয়ে গেল। সেই বুড়ো লোকটার দিকে তাকালো। ঘুমাচ্ছে। মুখটা কি ক্লান্ত। ছেলেটার মন জুড়ে কান্না এল। হঠাৎ। উদ্দাম সাহসটা থিতোবার সময় একটা কান্না আনে বরাবর। না কান্না পেলে ক্ষমা করা যায় না। ছেলেটা বাদামশূন্য নুনশুদ্ধ প্যাকেটটা জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিল।
তার স্টেশান আসতে আরো পাঁচটা স্টেশান বাকি। উঠে দাঁড়ালো। সামনের দাঁড়ানো লোকটাকে কাঁধে হাত দিয়ে ডাকল, দাদা বসুন। লোকটা বয়েস কত হবে? তার ছোটোকাকার মত? গত তিন বছর আগে ক্যান্সারে মারা গেছেন।
মৃত্যুযন্ত্রণার স্মৃতি মনের মধ্যে একটা উদারতা আনে। দরজার কাছটা একটু ফাঁকা হয়েছে। সে ঠেলেঠুলে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। মুখে জোলো বাতাস লাগল। বৃষ্টি হয়েছে তা হলে খানিক আগে। হ্যাঁ স্টেশানগুলোও ভিজে এদিকটায়। খেয়াল করেনি এতক্ষণ। ভিজে স্টেশানে আলোগুলো পড়ে বেশ একটা সুন্দর লাগছে দেখতে। মন খারাপটা যেমন চারদিক কালো করে দেয়, মন ভালো হলে সেই মনই খুব ছোঁয়াচে হয়ে যায়। পৃথিবীর আনাচে কানাচের ভালোলাগাগুলোকে টেনে টেনে বের করে আনে। গায়ে মুখে মাখে।


স্টেশান থেকে চপ কিনে নিল। বাড়ির কলিং বেল টিপতেই ও এসে দরজা খুলে দিল,
- আবার চপ এনেছো? বারবার বলি না, এসব খাইও না বাচ্চাটাকে, লিভারের বারোটা বেজে যাবে..... আরে এমনিতেই তো বারোমাস হেগে মরে...
ছেলেটা টাওয়েল নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। শাওয়ার খুলে দিতেই জলের সাথে সেই অদম্য সাহসটা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার সারা শরীরে আবার। চোখ বন্ধ করল।
সে একটা ঝরণার ধারে দাঁড়িয়ে। ওদিকে দাঁড়িয়ে ও - তার স্ত্রী। মাঝখানে ঝরণার ধারা। দুজনেই নগ্ন। ঝরণার জলের ফাঁকে ফাঁকে ওকে দেখা যাচ্ছে। তার শরীর মন একটা স্নিগ্ধ ভাললাগায় স্নান করে যাচ্ছে।
বাইরে শুনতে পাচ্ছে, দেখতো তোর বাবা বাথরুমে ঘুমিয়ে পড়ল কি না.....
হঠাৎ ঝরণার জলে ছলকে দেখল, কার একটা নগ্ন পিঠ!