Skip to main content
 
 
 
কাশি বড় অসাধারণ ক্রিয়া। প্রথম আদিম রিপু তবু বা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, কিন্তু কাশি? উঁহু। সে হবার নয়। ক্ষণে ক্ষণে, পদে পদে যত্রতত্র অপদস্থ হইবার প্রবল সম্ভাবনা। গীতায় আছে যিনি কাম-ক্রোধের বেগ সহ্য করতে পারেন তিনি যোগী। সে না হয় হল, কিন্তু কাশির বেগ যিনি সহ্য করতে পারেন? আমার মনে হয় তিনি হয় অশরীরী, নয় ভগবান, অবশ্যি দুজনেই তো অশরীরী, সে অন্য কথা।
       এর মধ্যে সব চাইতে বড় গোলমেলে বিষয় হচ্ছে শুকনো কাশি। আমাদের কাজের মাসি বলতেন, সুগনো কাসি.. "তা মা (আমার মাকে সম্বোধন করে) কাসতি কাসতি বুকের পাঁজর গুলানে এমনি ব্যথা, এমন কি ও বাড়ির ঘর মুছতি যেয়ে এমন কাশির দমক লাগা, কি বলব মা, পস্রাব বেরিয়ে যায় প্রায়।"
       মায়ের আর্তনাদের মত আওয়াজ তারপর, সেকি! তুমি ওদের মেঝেতে ওসব করে ফেলেছ নাকি?!
       মাসির বরাভয় দেওয়া কণ্ঠস্বর, মুসে দিসি মা..তবে ভয় নাই, আপনার এহানে হয় নাই...
       তা সেই বা একদিকে চব্বিশটা পাঁজরের যন্ত্রণার গুঁতো, তায় মূত্রস্থলীর সভ্যপানা সামলায় কি করে? একটাই তো মানুষ।
       তো এই হল কাশি, একবার শুরু হলে মনে হয় অনন্তকাল ধরে কাশব বলেই আমার জন্ম হয়েছিল। প্রাণপণে গলার খুসখুস ভাবটা জ্বালাতন করে যাচ্ছে, যেন কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছে, তার সে ডাকে সাড়া দিতে পেটের পেশি থেকে, বুকের পেশি, পাঁজর, গলা ঘাড় চোয়াল একযোগে মহা সমারোহে ঝাঁপিয়ে পড়ল আপনাকে নিয়ে, দেশকালপাত্র কিচ্ছু বিবেচনা করল না, আপনি নয় রুমাল, নয় করকমল নিজের প্রবলভাবে স্ফীত দন্তবিকশিত গুহাদ্বার বন্ধ করে শব্দ ও অভিব্যক্তি যতটা স্বাভাবিক রাখা যায় চেষ্টা করতে করতে হয়ত বা পশ্চিমী কায়দায় একটা "সরি" শব্দ উচ্চারণ করতে চাইছেন, কিন্তু সে সময় দিলে তো! ততক্ষণে সবাই তাদের কথা থামিয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে, কেউ অপেক্ষায়, কেউ বিরক্তিতে, কেউ সহমর্মিতায়, কেউ উদাসীনতায়। আপনি এইভাবে লাইমলাইটে আসতে যদিও চাননি, তবু আপনি এসে গেছেন। হাজার সাধ্যসাধন করেও হয় তো যে জনতার দৃষ্টি থেকে আপনি বঞ্চিত, আজ শুধু এক কাশি আপনাকে সেই অবস্থায় এনে ফেলেছে দেখছেন।
       এরপর হল রাতের কাশি। এইবার আপনার একক নাটকের পালা। বালিশে মাথা রাখলেন, ব্যস ওইটুকুই। সেই গলার ভিতর অদৃশ্য আঙুলের মিহি সুড়সুড়ি। ক্রমশ শরীর তার শতাধিক পেশিকে নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে, রেডি? ব্যস, এসে গেছে, আপনি বালিশ থেকে মাথাটা পিং পং বলের মত তুলছেন রাখছেন, হরি-আল্লা-যীশুকে ডাকছেন, মা-বাপ শ্বশুর শাশুড়ি ডাকছেন - কেউ সাড়া দিচ্ছে না, 'মনে করো শেষের সেদিন ভয়ংকর'। শীতকাল, বন্ধ পাখাটা আপনার কাশন্ত অবস্থার দিকে তাকিয়ে, চার‍টে দেওয়ালে আপনার কাশি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে, বিছানা আপনার খাটের উপর অরতিক্রিয়ার দাপটে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করছে, আপনি শুধু কাশছেন, কাশছেন আর কাশছেন।
       হঠাৎ দমক থামল। সমস্ত ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা। আপনার গলা ভোলাভালা শান্তশিষ্ট অঙ্গ বিশেষ তখন। শুধু পাঁজর তলপেট পিঠে কিঞ্চিৎ যন্ত্রণা। আপনি আকাঙ্খা করছেন ঘুমের আর আশঙ্কা করছেন কাশির। আশঙ্কাই সত্যি হল।
       এরপর আশে সীতারমণের বাজেটের মত কাফসিরাপের সাজেশান। কিস্যু হবে না। পিপের পর পিপে গিলে যাবেন, কেশেই যাবেন কেশেই যাবেন। আপনি হয় তো বড়জোর ভাববেন কাশির আওয়াজের ডেসিবেলের পরিবর্তন হচ্ছে, দমকের মধ্যে সময়ের গ্যাপ বাড়ছে, কিন্তু আপনি জানেন আপনি নিজেকে ঠকাচ্ছেন। বন্ধুবান্ধব, শালা-শালী, চিকিৎসক, পাড়াতুতো, ফেসবুকতুতো, অফিসগত, নিত্যযাত্রীগত ইত্যাদি হাজার মানুষের হাজার একটা কাফসিরাপ, টোটকা চালিয়ে যাবেন, চালিয়েই যাবেন, কিন্তু জানেবন, কাশি সেই দিনই আপনাকে ছাড়বে যেদিন সে স্থির করেছে আপনাকে ছাড়বে। এ একদম অব্যর্থ কথা।
       শুকনো কাশিকে নিয়ে এত কথা বলার কারণ একটাই, ভেজা কাশির একটা উদ্দেশ্য আছে, সে একটা কিছু বার করে আপনাকে ছাড় দেবে (কথাটা সভ্য ভাবে নেবেন প্লিজ।) সেখানে আপনি জানেন আপনার কাশির উদ্দেশ্য কি। একটা ফলাফল দেখে, সে পাতলা হোক, ঘন হোক, সাদা হোক, সবুজ হোক, হলদে হোক, যা কিছু একটা হোক - আপনার শ্রমের আপনি একটা মূল্যও পেলেন মনে হবে, কিন্তু শুকনো কাশি অহেতুকী লীলা। আপনি কেন কাশছেন জানেন না। কি তার উদ্দেশ্য কেউ জানে না। কিন্তু আপনি নিজেকে নিরস্ত করতে অপরাগ। নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিন। আর বাকি কাজ ফলাফলের আশা ত্যাগ করে চালিয়ে যান। এই দর্শনেই ইতি টানি। খানিক কেশে নিই। জয়গুরু।