নন্দদা দার্শনিক মানুষ। সেই স্কুলজীবন থেকেই। শোনা যায় নাকি ওনার দর্শনের বহর দেখে স্কুলের হেডস্যার কাশী থেকে নাম করা জ্যোতিষী আনিয়ে নন্দবাবুর হস্তরেখা বিচার করিয়েছিলেন। যদি শঙ্করাচার্য্য বা অরবিন্দের মতন কিছু নিদর্শন পেতেন, তো বিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই নন্দবাবুর আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠার কথা মনে মনে স্থির করে ফেলেছিলেন। শিল্পীকে আগাম বলাও হয়ে গিয়েছিল। রকমসকম দেখে কাশীর পণ্ডিত বিধানও দিয়ে বসলেন – এ ছেলে বড় হয়ে বহু দার্শনিকের নাম ডোবাবে।
হেডস্যার সংশয়ে পড়ে গেলেন। কথাটা সদর্থে না ব্যাঙ্গার্থে সঠিক বুঝে উঠতে না পেরে ফের জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তর একই এল। এদিকে বারবার জিজ্ঞাসাও করা যাচ্ছে না। কারণ প্রতি শব্দ পিছু জ্যোতিষী মহাশয় পঞ্চান্ন টাকা করে চেয়েছেন। স্কুল কমিটি থেকে তো আর এ টাকা নেওয়া যায় না। অগত্যা, নিজের পকেট থেকেই দিতে হয়েছে। তো তিনি ঠিক করলেন, বেশ দুটো বছর দেখাই যাক না হয়, রিটায়ার করতে তো আরো ছ'বছর বাকি!
বেশি দেরি করতে হল না অবশ্য। নন্দবাবু তখন ক্লাস নাইনে পড়েন, সেই সময়েই ক্লাস টুয়েলভের এক মেয়ের সাথে তাঁর ভাব হয়ে যায়। স্কুলে রাষ্ট্র হয়ে যায়। হেডস্যার বদলী নিয়ে অন্য স্কুলে চলে যান।
এখন নন্দবাবুর পঞ্চান্ন বছর বয়েস। স্ত্রী সেই তিন বছরের বড় বিলুটিদেবী। মেজাজের জন্য পাড়ায় বিখ্যাত। শোনা যায় ওদের পাড়ায় নাইট গার্ডের ব্যবস্থায় ওনার যেদিন পালা থাকে, সেদিন কারোর থাকার দরকার হয় না। এমনকি যাদের থেকে বাঁচার জন্য এ ব্যবস্থা, তারাও নাকি পাশের পাড়াও এড়িয়ে যায় সেই রাতে। অথবা বেরোয়-ই না।
এবার গল্পে আসি। বেশ কয়েক মাস হল, নন্দবাবুর দার্শনিক সত্তাটা বেশ ভালরকম জেগে উঠেছে। সেদিন হল কি, বিলুটিদেবী বললেন, “হ্যাঁ গো গাছের কাঁঠালটা কেমন পেকেছে দেখেছো? এবার ওটা পাড়বার ব্যবস্থা করো, পুকুরের ওদিকে যা জোঁক আমার যেতে গা ঘিনঘিন করে।“
নন্দবাবু পুকুরধারে দা নিয়ে গেলেন। কাঁঠালটা দেখেই মনের মধ্যে কেমন একটা ভাব জন্মালো। ভাবলেন, 'আচ্ছা আমি যদি কাঁঠালটার দিকে না তাকাই, তবে কি কাঁঠালটা আছে? কাঁঠালটার থাকা না থাকা কি আমার দেখা না দেখার উপর নির্ভর করছে না?'
ব্যস। ঘরে ফিরে এলেন। কাঁঠালটার কথা ভাববেন না ঠিক করলেন। তবে কি ওর অনস্তিত্ব প্রমান হচ্ছে না এতে?
পরেরদিন ঘুম ভাঙল ব্রিগেডের মাঠে। মানে আর কি বিলুটিদেবীর আর্তনাদে। যা ভয় পাচ্ছিলেন তাই হল। কাঁঠাল চুরি হয়ে গেছে। সারাদিন চিৎকার চেঁচামেচি বিস্তর হল। বিলুটিদেবী কিচ্ছু খেলেন না। অগত্যা নন্দবাবুরও খাওয়া হল না। না খেয়েই অফিস গেলেন। সারাদিন ভাবলেন, আচ্ছা, কাঁঠালটা যদি অন্য কারো দ্বারা ভক্ষিত হয়ে থাকে, তবে কি সেটা অস্তিত্বের থেকে শূন্যে চলে গেল? যদি নন্দবাবু ও তাঁর স্ত্রী কাঁঠালটার কথা না জানতেন, তবে কি ওর অস্তিত্ব থাকত? তবে আর কেউ
নিলে বা খেলে তারা জানতে পারতেন? না তো! অর্থাৎ এ শোক আপাত। সঠিক অর্থে নয়।
মনটা ততক্ষণে ফুরফুরে হয়ে গেছে নন্দবাবুর, বাড়ি ফিরেই বিলুটিদেবীকে ডেকে বললেন, বোসো। বিলুটি বসলেন।
সারাদিন নন্দবাবু অভুক্ত। বিলুটিদেবীর মনে একটা অপরাধবোধ কাজ তো করছিলোই। অগত্যা মেজাজটা ওনার পড়েই গিয়েছিল অনেকক্ষন। ওদিকে নন্দবাবু উদ্ভাসিত মুখে বলতে শুরু করলেন তার 'অস্তিত্ব-অনস্তিত্ববাদের তত্ত্ব'।
সবটা শুনে বিলুটিদেবীর মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে লাগল। লোকটা বলে কি? যা দেখার বাইরে তা অস্তিত্ত্বের বাইরে?! তিনি বললেন, "হ্যাঁ গো, এই যে আমি যখন পুরুলিয়ায় বাপের বাড়ি যাই, কিম্বা ধরো চুরুলিয়ায় ছোটপিসির বাড়ি যাই, অথবা ধরো যখন তুমি অফিসে থাকো – তখন আমার অস্তিত্ব নেই তোমার কাছে?"
নন্দবাবু বললেন, "তা তো নয়। তখন তো তুমি আমার জানার মধ্যে।" বিলুটিদেবী বললেন, "সে তো কাঁঠালটাও জানার মধ্যে ছিল!"
ফ্যাসাদে পড়লেন নন্দবাবু। কি করেন। কেন তবে জানা আর দেখার মধ্যে তফাত করতে পারছেন না? অস্বস্তিতে পড়লেন।
বিলুটিদেবী বললেন, "বেশ তুমি ভাব। আমি ভাত বাড়ি।"
নন্দবাবু বললেন, "না গো, সন্ধ্যে হয়ে আসছে, এই অবেলায় ভাত আর খাব না, সারাদিন কিছু খাওয়াও হয়নি, তুমি বরং মুড়ি তরকারি দাও।"
বিলুটিদেবীর কথাটা শুনেই কান্না পেয়ে গেল। তিনি, 'আচ্ছা আনছি' বলে রান্নাঘরের দিকে গেলেন মুখটা লুকিয়ে। ফিরে এসে দেখেন, নন্দবাবু চিৎ হয়ে শুয়ে একটা পায়ের উপর আরেকটা পা তুলে গুনগুন করে, ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ গাইছেন। এর অর্থ ওর মাথার মধ্যে জটিলতাটা গেছে।
তিনি ঘরে আসতেই একলাফে উঠে বললেন, "পেয়েছি উত্তর। তুমি তো আমার জানার মধ্যে নেই শুধু। তুমি আমার প্রেমের মধ্যে আছো। তাই জানা বা দেখার থেকে সেটা বেশি সত্যি। যেমন ধরো যে
আমাদের পেপার দেয়, সুকুমার, তাকে না দেখলে কি আমরা তার অস্তিত্ব নিয়ে ভাবি? না তো! কারণ সে শুধু জানার মধ্যে আছে। প্রেমের মধ্যে নেই।"
"আছে!" হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন বিলুটিদেবী।
"অ্যাঁ! কি বলো গিন্নী?" নন্দবাবুর মুখ শুকিয়ে গেল মুহুর্তেই।
"ও আমায় দিদি ডাকে, ওকে একদিন না দেখলে আমার মনটা উতলা হয়, ওর বউটাও কি যে মিষ্টি!"
এবার নন্দবাবুর মাথা ঘোরাচ্ছে। 'ভোঁ ভোঁ' করছে কানের কাছটা। সব দর্শনের তত্ত্ব কর্পূরের মত উড়ে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। তিনি ঢোক গিলে বললেন, "তুমি একটুও দর্শন মতে চলতে পারো না বিলুটি?"
বিলুটিদেবী কোমল গলায় বললেন (যা অবশ্যই সংসারে সুদুর্লভ ঘটনার মধ্যে পড়ে), "দেখো পুরো সংসারটাকে তোমরা পুরুষমানুষেরা হিসাব নিকাশের খোপে ভাগ ভাগ করে দেখো, তাই এত ভাবার সুযোগ পাও। আর আমরা ওই কাঁঠালটার
থেকে সুকুমার, তুমি – পুরো সংসারটাকেই অনুভবের চোখে দেখি। তাই ভাগ করার অবকাশ পাই না। তোমাদের কাজকারবার দেখলে মনে হয় বুড়োখোকাদের খেলা। যেন পুরো সংসারটার এমাথা ওমাথা পড়া হয়ে গেছে তোমাদের। হেঁশেল থেকে এ দৃশ্য দেখলে হাসি পায় আমাদের। প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছা করে। কারণ তোমরা ওটুকু অহংকার না হলে যে বাঁচতে পারো না। তাই আমরা মেয়েরা আঁচলের আড়াল টেনে ওটুকু অহংকারকে বাঁচিয়ে রাখি তোমাদের। বুঝলে হাঁদুরাম মহেশ্বর আমার!"
এই বলে বিলুটিদেবী নন্দবাবুর নাকটা টিপে দিয়ে বললেন, "উঠি, নেতাইয়ের মা'টা বাতে বড় কষ্ট পাচ্ছে, একটু তেল গরম করে দিয়ে আসি। আরে সেই তেলটা যেটা তুমি আমার বাতের সময় এনেছিলে আহমেদপুর থেকে, মনে নেই?"
নন্দবাবু 'হাঁ' করে তাকিয়ে আছেন বিলুটির মুখের দিকে। কথা সরছে না।
বিলুটিদেবী যেতে যেতে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গিয়ে ফিরে তাকালেন। বললেন, "কাঁঠাল কে নিয়েছে আমি জানি। হরেন, যে ভ্যান চালায় গো। ভাবছি ফেরার সময় ওর বাড়ি হয়ে আসি, দুটো কাঁঠাল মুখে না দিলে ওরা পেট ফেঁপে মরবে যে!"
বিলুটিদেবীর চোখেমুখে দুষ্টুমির হাসি। নন্দবাবু ভেবলে বসে, কোনোরকমে বললেন, "তবে আমার জন্যেও দু-এক কোয়া এনো, বাড়িতে অ্যাসিলক আছে তো?"
(ছবিঃ সুমন)