Skip to main content

পকাদা একজন সমাজ সচেতন নাগরিক। সমাজ নিয়ে প্রচুর ভাবনা। মাঝে মাঝে পকাদা বলে, "আমি যা যা ভেবেছি বিশু, লিখলে রবীন্দ্রনাথকেও হার মানাত।"

    আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তা লিখলে না কেন গো?

    পকাদা উদাস হয়ে ভাইদা'র চায়ের দোকানের কানাভাঙা বেঞ্চে বসে, ভাঁড়ের চিনি ছাড়া দুধ চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলেছিল, "রবীন্দ্রনাথকেই কেউ পড়ল না, আর তোদের প্রদ্যুত সামন্ত'র লেখা পড়ছে"...

    পকাদা, ওরফে প্রদ্যুৎ সামন্ত, মাঝবয়েসী, মোটাসোটা, সরকারি চাকুরে, খানিক অলস প্রকৃতির জীব, অবশ্য শেষ কথাটা পকাদা'র বউ মাধুরী বউদির উক্তি। পকাদা ডিফেন্সে বলে, "ভাবুকদের অর্বাচীনের দল অলসই বলে রে বিশু, তুই ইতিহাস ঘাঁট।"

    আজকের ঘটনায় আসি। আমি চায়ের দোকানে গিয়ে পকাদাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, "শুনেছ, আমাদের কেলো কার্তিক ভ্যাক্সিন পেয়েছে আজ।" কেলো কার্তিক হল আমাদের বন্ধুমহলের ডাক্তার। সে কল্যাণী'র এক সরকারি হাস্পাতালে আছে।

    পকাদা স্বভাবসিদ্ধ উদাস গলায় বলল, "জানি, টেক্সট করেছিল। সুস্থ আছে।"

    পকাদা কি একটা ভাবতে শুরু করল। রাস্তার পাশ দিয়ে হুস হুস করে গাড়ি চলে যাচ্ছে। পকাদা ভুরু কুঁচকে, ঠোঁটের ডগায় ঝুলন্ত জ্বলন্ত সিগারেট মুখে ভাবছে।

    "একটা কোথাও গোলমাল হচ্ছে রে বিশু, খুব গোলমাল, একটা ছবি মনে আসছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে কাজটা উচিৎ, কিন্তু কেউ গলা তুলছে না"....

    কি পকাদা?

    "আচ্ছা বল, চিকিৎসকদের পরেই এই ভ্যাক্সিন কাদের প্রাপ্য বলে তোর মনে হয়? কিম্বা চিকিৎসকদের সঙ্গেই কাদের নাম আসা উচিৎ ছিল বলে তোর মনে হয়?"

    পুলিশ?

    "হল না"

    তবে?

    "সেক্স ওয়ার্কার"

    অ্যাঁ!

    "তুই বল, মানুষের সঙ্গে আর কোন প্রফেশানে মানুষ অত ঘনিষ্ঠতায় আসে? আসে কেউ?"

    না, ইয়ে মানে, তা আসে না।

    "তবে ভ্যাক্সিন তো ওখানে আগে যাওয়া উচিৎ ছিল, নাকি?"

    আমি আসলে এভাবে ভাবিনি।

    "আমরা কেউই ভাবি না, ওরা তো আসলে আমাদের শিক্ষিত ভদ্র সমাজের আওতায় পড়ে না, তাই…"

    তা তুমি কি করবে ভাবছ? চিঠি লিখবে? তুমি তো আর সোশ্যাল মিডিয়ায় আসবে না…

    "চিঠিই লিখব ভাবছি কোনো একটা পেপারে, দেখি..."

    তারপর মাসাজ পার্লার এগুলোও তো আছে বলো…

    "আছে, ধীরে ধীরে সব দিতে হবে। তবে কি জানিস, আমরা সবাই তাই ভাবতে চাই যা আমাদের দিয়ে সমাজ ভাবাতে চায়। শাসকের সব চাইতে বড় সফলতাই সেখানে। এই যেমন ধর কৃষকদের আন্দোলনের ব্যাপারটা। আমাদের যাদবপুর থেকে দিল্লীর জওহরলাল, ছাত্ররা কেন এত চুপ? এই যদি কাশ্মীর কি সেরকম কিছু একটা ইন্টেলেকচুয়াল লেভেলের বিতর্ক হত তবে তো সব ঝাঁপিয়ে পড়ত। পড়ত না? কত বিচিত্র ধারার প্রতিবাদ তো দেখেছি সেখান থেকে আমরা স্যানিটারি ন্যাপকিন ট্যাপকিন নিয়ে... কিন্তু এখন সব চুপ... রাস্তায় কাঁটা বসে যাচ্ছে, জল, কারেন্ট, মোবাইল কানেকশান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে… তাও সবাই চুপ, তোদের কে একজন হালের চে গুয়েভারা জন্মেছিল না? কি যেন নাম? কানহাইয়া, ঐশী…. এরা সব কোথায় রে?"

    শুনেছি মাঝে মাঝে টুইট করছে…

    "ও বাব্বা, সেতো মহাবিপ্লব! হো হো হো..."

    রাহুল?

    "হাসাইলে বালক মোরে বাক্যের কৌশলে..."

    হুম্...

    "মন খারাপ হয়ে যায়। এসব থেমে যাবে। কিন্তু কিভাবে থামবে সেটাই বড় কথা রে।"

    মানে?

    "মানে যে ন্যায় মানবিক সে ন্যায়ের দিকে জিত? না, যে কৌশল রাজার সে কৌশলের দিকে জিত?"

    তুমি কি বিলটা পড়ে বুঝেছ?

    "অনেক বিষয় আছে। যেমন চেতন ভগতের মতে ভালোমন্দ মেশানো; অমর্ত্য, অভিজিৎ বাবুদের মতে ভালো না। আবার সরকারি তরফে বলা হচ্ছে ভালো।"

    তো?

    "কৃষকেরা কি বলছে? এরা তো কেউ কৃষক না? নাকি আমরা ধরেই নিয়েছি কৃষক মানেই নন ইন্টেলেকচুয়াল? ওদের হয়ে আমরাই যা বলার বলব, ঠিক করব?"

    কিন্তু দেশের বাকি কৃষকেরা তো কিছু বলছে না….

    "যারা বলছে তারা কেন বলছে সেটাই বড় কথা, যারা চুপ করে আছে, যারা কোনো পক্ষেই নড়ছে না তারা আপাতত অদৃশ্যই থাক। তাদের উপর এই অত্যাচারের অধিকার কে দিয়েছে? কোন আইন?"

    কিন্তু দিল্লীতে যা হল?

    "যারা দোষী তাদের ধরা হোক, আইন অনুযায়ী বিচার হোক, কিন্তু তা বলে সবার জল, মোবাইল কানেকশন কেন বন্ধ হবে? কেন রাস্তায় কাঁটা বোনা হবে?"

    সবাই একত্রিত হচ্ছে নাই বা কেন?

    "সঠিক নেতৃত্বের অভাব। নেতৃত্বের প্রধান কথাই হল একত্রিত করা। জোট বাঁধানো। নইলে ভাব, মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিপ্লবীর হাতে পুরো কিউবা ছেড়ে, অত সৈন্যসামন্তের মালিক বাতিস্তার মত অত শক্তিশালী ডিক্টেটর পালিয়েছিল কেন? কারণ কাস্ত্রো'র নেতৃত্বের জোর। ওদের সঠিক নেতৃত্ব নেই, এই হল কথা। তবে এদের জোর আছে।"

    কি হবে তবে?

    "অপেক্ষা করতে হবে। গণতন্ত্র বড় রণক্ষেত্র রে ভায়া। এখানে লড়াই রাজায় রাজায়, ক্ষমতায় ক্ষমতায় না, এখানে দুর্বলতম ব্যক্তির যোগ্যতম সুরক্ষা আর জীবনযাপনের ব্যবস্থাই মূলমন্ত্র। সে রণাঙ্গন মানবিকতার বিরুদ্ধ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে, রাজার বিরুদ্ধে না। এটা মনে রাখতে হবে।"

    পকাদা বাজারের ব্যাগ নিয়ে উঠে গেল। যেতে যেতে বলল, "কৃষকদের অবহেলা কর কর, বাজারকে পারবি? একি তোর চাইনিজ রেডমি ফোন রে বাবা, দেশে হল না তো বিদেশ থেকে আনিয়ে নিবি?"

    মনে মনে ভাবছি তাই তো... এমন সময় হোয়াটস অ্যাপে একটা মিম ঢুকল, আগে সেটা কি নিয়ে দেখি…