Skip to main content

আশ্চর্য হওয়ার তো কিছু হয়নি, বলে রণিতা পাশের ঘরে চলে গেল শাড়ি ছাড়তে। রণিতার মা কিছুক্ষণ ছাদ থেকে আনা শুকনো কাপড়গুলো কোলে নিয়ে সোফাটায় বসে রইলেন। জানলা দিয়ে সামনের বড় রাস্তাটা দেখা যায়। দুপুর তিনটে, বৈশাখের কাঠফাটা রোদ। রাস্তাটা শুনশান।
রমা মানে রণিতার মা, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। স্বামীর ছবিটার দিকে তাকালেন। ধুলো জমেছে মনে হল। পাখাটার আওয়াজে অন্যদিন এই সময় হলে ঝিমুনি লাগত, আজ লাগছে না। জল তেষ্টাও পাচ্ছে, কিন্তু উঠে টেবিল অবধি গিয়ে জল খেতে ইচ্ছে করছে না।
রণিতা একটা সালোয়ার কামিজ পরে বেরোলো। বেশ সুন্দর দেখতে হয়েছে মেয়েটাকে। যতবারই তাকান, রমার ততবারই মনে হয় সে কথা। শাশুড়ি মা অবশ্য বলতেন, "বৌমা মেয়ে যখন বড় হবে, বুঝবা, সুন্দরী কাকে বলে। পাড়ায় ছেলেদের লাইন লেগে যাবে।" রমার মুখে একটা ঈষৎ হাসির রেখা ভেসে উঠল।
"ভাত বাড়ো", বলে রণিতা বেসিনের কাছে গিয়ে মুখে সাবান দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করল, কালকের চিকেনটা আছে?
- হ্যাঁ আছে, আয়। রমা নিজেও খাননি। রণিতা বলেছিল ওর আজ ক্লাস সেরকম একটা নেই বিশেষ কলেজে। ওর এটা থার্ড ইয়ার, কেমিস্ট্রি।
দু'জনেই খেতে বসল মুখোমুখি। রণিতা রমার চোখ যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাচ্ছে।
- কেন না করলি তুই?
- কেন করব না?
- আগে না এর কারণটা কি তাই তো শুনি?
- তুমি তো জানো, আগে আমি মাষ্টার্স করব, রিসার্চে যাব। তারপর কিছু একটা ভাবব।
- কিন্তু ওদেরও তো আপত্তি নেই তোর পড়াশোনা চালানোয়।
- ডালটা কি তুমি করেছ না পারুলদি (রান্নার লোক)?
- আমি, কেন?
- না কিছু না। আরে ওদের আপত্তি থাকা না থাকায় আমার কিছু যায় আসে না। আমি না বলেছি, মানে না।
পাখার আওয়াজ। জানলার কাঁচ একটা ছাতার পাখি এসে ঠকঠক করে ঠুকে চলেছে। রমা বললেন, আচার নিবি?
- না
- তোর যে কাউকে পছন্দ হয়েছে তেমনও তো বলিস না
রণিতা কথা না বলে স্মার্টফোনে কিছু একটা করছে।
- অন্তত খাওয়ার সময় ওটাকে একটু দূরে রাখা যায় না। আরে বাবা ফোন তো ফোন। তাতে সারাদিন এত কি কাজ তো বুঝি না। সারাদিন কুটুর কুটুর। বিরক্ত লাগে।
রণিতা ফোনটা পাশে রেখে বলল, "অকারণ ফোনের উপর রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। তোমার বোনের আনা এন আর আই সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিচ্ছি তাতেই যত গণ্ডগোল, তাই তো?"
রমা কোনো কথা না বলে, নিঃশব্দে খেতে লাগলেন।

রণিতা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। রমা তাঁর ঘরে এসে খবরের কাগজটা খুলে বসলেন।
হঠাৎ দড়াম করে একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল রমার। বাইরেটা কালো করে এসেছে। ঝড় আসছে। ঘড়ির দিকে তাকালেন, সাড়ে পাঁচটা। জানলাগুলো বন্ধ করতে গিয়ে করলেন না। জানলার ধারে এসে দাঁড়ালেন। বাইরের গাছগুলো পাগলের মত উদ্দাম নৃত্য করছে। ভাঙবে মনে হচ্ছে ক'টা আজকে। কারেন্ট চলে গেল। ঘরের ভিতরটা পুরো অন্ধকার।
আচমকা রমার কেন জানি কান্না পেল। হঠাৎ তার মনে পড়ল, এ বাড়িতে বউ হয়ে আসা প্রথম দিনটার কথা। তখন তিনতলা বাড়ি জমজমাট। ওর স্বামীর দুই ভাই এই বাড়িতে। ওর স্বামী ছিলেন সবার ছোট। সেদিনও কি ঝড়! রমার বিয়ে হয়েছিল ভাদ্র মাসে (শাশুড়ির জেদেই, উনি সংস্কার মানতেন না), তারপর বড় ভাশুর ওরই মত ক্যান্সারে মারা গেল। ছোটো ভাশুর ট্রান্সফার হয়ে পূণেতে। শ্বশুর শাশুড়ি চলে গেলেন। পুরো বাড়িটা নির্বান্ধবপুরী হয়ে দাঁড়াল। তারপর সকলের পরামর্শে নীচতলা দুটো ভাড়া দিয়েছেন। ছোটো ভাশুর আর আসবে না এদিকে জানিয়ে দিয়েছে।
- বৌদি মান্তুর মা এসেছে কাজে?
রমার ঘোর ভাঙল। সামনের বাড়ির নতুন বউটা। ছাদে ভিজছে।
- ছাদে কি করছ?
- আরে বউদি কদ্দিন ভিজি না গো! এসো না, দারুণ লাগবে। এসো না গো!
রমা তাকাল ভাল করে নতুন বউটার দিকে। সারা গায়ে নীল শাড়িটা লতার মত জড়িয়ে আছে মেয়েটাকে। ক্ষীণ শরীরে যেন বিন্দুমাত্র লজ্জার দায় নেই ওর আজ। দেখতে দেখতে রমার বুকের ভিতরটা হঠাৎ ছলকে উঠল। ভিজবে?! সত্যিই তো ভেজেনা কতদিন। যাবে? ওদের ছাদ আর তাদের বাড়ির ছাদ লাগোয়া। যাবে?
হঠাৎ কি হল রমার, সে আঁচলটা কোমরে জড়াতে জড়াতে বলল, "দাঁড়া আসছি।" নতুন বউ হাততালি দিয়ে দু'বার নেচে উঠে বলল, "ইস্, শীগ্গীরি এসো...."
রমা রণিতার ঘরে ঢুকে দেখে, রণিতা উপুড় হয়ে শুয়ে মোবাইলে কি করছে। রমা তার পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে, "চল ভিজবি?"
রণিতা কিছু বুঝে উঠবার আগেই, রমা তার হাত ধরে টানতে টানতে সিঁড়ির কাছে নিয়ে আসে।
রণিতা আচমকা থেমে রমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, "আমি চলে গেলে কে দেখবে তোমায়?"
বাজ পড়ল? না তো। রমা ছাদের দিকে মুখ করে বলে, আয় তাড়াতাড়ি, বৃষ্টি ধরে যাবে যে....

(ছবি - সুমন)