ঘটনা সামান্য। কী হল বলি। মাষ্টার তো পড়াতে পড়াতে রাত সাড়ে ন'টা করে ফেলল। ছাত্রীর মা বলল, স্যার আজকে আর ওই বাঁশঝাড়, পুকুরপাড় দিয়ে যাবেন না, আপনি বাজারের দিকটা দিয়ে যান। জানেনই তো আগামীকাল মহালয়া। কত কী যে থাকতে পারে ওখানে.....
মাষ্টার আর ছাত্রী দুজনেই হাসল। মৃদু। মাষ্টারের হাসির ভাব ছিল, হে হে, আমি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, যা দেখি তা-ই বিশ্বাস করি না, আবার যা দেখিনি।
আর ছাত্রী হাসল, ভাবল, যা ঘাওড়া মাষ্টার, এই ফাঁকে যদি ভূতের নেকনজরে পড়ে, পুজোটায় শান্তি। নইলে বলে কিনা সপ্তমীর দিন সকালে অঙ্ক করাবে?!
যা হোক। মাষ্টারের সাইকেল যখন বাঁশ বাগানের দিকে বাঁক নিল, ছাত্রীর মা বলল, দুর্গা দুর্গা। মেয়ে মনে মনে বলল, দে ব্যাটার ঘাড়টা মটকে…..
=====
মাষ্টার জানে যা চোখে দেখা যায় তাকে মনের বাইরে চাইলে রাখাও যায়, কিন্তু যা চোখে দেখা যায় না, তাকে মনের মধ্যে একবার ঢোকালে আর রক্ষে নেই। বাঁশঝাড়টা অমাবস্যার অন্ধকারে পাহাড়ের মত হয়ে আছে। দু একটা কুকুর ডাকছে। মাষ্টার বুঝল মনের মধ্যে কে যেন ঢুকে গেছে।
সাইকেল যত বাঁশঝাড়ের দিকে এগোয় মাষ্টারের সাইকেলের গতিবেগ আসে কমে। ভুল হল। জেদ করাটা উচিত হল না। ফিরবে? কিন্তু একটাই রাস্তা, ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে আবার যাওয়াটা কেমন মানসম্মানের ব্যাপার না?
ফেরার পথ নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার সামনেটা। খুব জোরে চালালে এক থেকে দেড় মিনিট বাঁশঝাড়টা। কিন্তু জোরে চালাবে কী করে? ইতিমধ্যে তলপেটে প্রেশার। একবার নামতেই হবে।
মাষ্টার সাইকেল স্ট্যাণ্ড করে নামল। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে চারদিক তাকাচ্ছে, ইচ্ছা নেই, তবু তাকাচ্ছে। মনের মধ্যে কে যেন বলছে, দেখ দেখ…. একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবি।
যা হোক, প্রাকৃতিক কাজটা সারা হল। ঘুরে সাইকেলের দিকে তাকিয়েই মনে হল সারাটা শরীর বরফে স্নান করিয়ে দিল কেউ। সাইকেলের ক্যারিয়ারের উপর বসে একটা কালো কুচকুচে বেড়াল। তার দিকে তাকিয়ে। বিশ্রী জ্বলজ্বলে চোখ।
কেউ যেন হিপনোটাইজ করেছে। নড়াচড়ার শক্তি নেই। পা দুটো কাঁপছে। এমন সময় কেউ যেন বলল, ওই যা… হুস!
বেড়ালটা বিকট ডেকে, এক লাফ দিয়ে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিটকেল আঁশটে গন্ধে চারদিক ভরে গেল।
মাষ্টার সাইকেলটার কাছে নিজেকে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। সাইকেলে উঠবে কী, শক্তি কোথায়? হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে? মারা যাবে তবে। কান্না পাচ্ছে।
সাইকেলে উঠে প্যাডেলে চাপ দিল। সাইকেল গড়িয়ে বাঁশবাগানে ঢুকল। কিন্তু এগোচ্ছে না তো। হাতটা শক্ত হয়ে আসছে। পা'টা জড়পদার্থর মত হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল কিছুতে ধাক্কা দিল পিছন থেকে। মাষ্টার মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। সাইকেলটা পড়ল ছিটকে। ঠোঁট কেটেছে। রক্তের স্বাদ পাচ্ছে। কিন্তু.. কিন্তু… চোখটা বন্ধ করে নিল। আশেপাশে অনেকের কথা বলার আওয়াজ। খুব কাছাকাছি যেন কারা।
তাকালো। পুকুরের জলের আওয়াজে তাকালো। কেউ যেন সাঁতার কাটছে। যেন না, সত্যিই তো সাঁতার কাটছে। জলের মধ্যে সাঁতার কাটার শব্দ, জলের মধ্যে ঢেউ ওঠা। কিন্তু কে?
যতটা তাকানো সম্ভব তাকিয়ে দেখল। দুটো হাত। ধড় নেই, মাথা নেই, পা নেই। পুকুরের এমাথা ওমাথা সাঁতার কাটছে।
নড়াচড়ার শক্তি নেই। ভাবার শক্তি নেই। ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছে। আচমকা সাইকেলটা দাঁড়িয়ে গেল। দুটো পা শুধু। সাইকেলটার দুই প্যাডেলে। কেউ যেন কানের কাছে বলছে, আমার এরকমই সাইকেল ছিল…. ঠিক এরকম……. আয় আয় দেখবি….. কাটা পড়েছিলাম…. এই রেলগেটে…. কানে হেডফোন ছিল….. রাতের গেদে…. শালা এক্কেবারে…..
মাষ্টার উবু হয়ে বসে। কাঁপছে থরথর করে। মাষ্টারের চোখের সামনে একটা কাটা মাথা….. সে কথা বলে যাচ্ছে…. জিভটা বারবার বাইরে এসে পড়ছে…. মাটি ভিজছে রক্তের দাগে… এত অন্ধকার…. তাও যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে…. মাথাটা চেনা…. ছাত্রীর কাকার…. দেওয়ালে ছবি টাঙানো….. দেখেছে অনেকবার….. ওরা বলেছিল…. অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল কাকা।