বৃষ্টি এলো হঠাৎ। বেমানান লাগল না। যেন আসারই ছিল। ছোটো স্টেশান। ঘাস উঠেছে নেড়া হয়ে সদ্য চুল গজানো মাথার মত এখানে সেখানে অল্পস্বল্প। মুখোমুখি দুটো প্ল্যাটফর্ম ভিজছে। দিগন্ত ছোঁয়া সবুজ মাঠ উৎফুল্ল হয়ে আকাশকে ডাকছে বুকের উপর, এসো।
ট্রেনের জানলার উপর হাত রেখে জাহ্নবীও বলেছে, এসো তবে, ভালো থেকো, সাবধানে যেও।
ট্রেন চলে গেছে। জাহ্নবীর হাতে লেগে জানলার লোহার গন্ধ। জাহ্নবী ভিজছে। আটত্রিশ বছরের শরীরটাকে চেনার নতুন করে কিছু নেই। কিন্তু মনটা? উনুনের মাটির মত পোড়ে, আবার নতুন করে লেপতে হয়, যাতে আবার পুড়তে পারে। জাহ্নবী বাজারি। যে চলে গেল, তার পরিবার আছে। সে গেলো, ছট কাটাবে তাদের সঙ্গে। এখানে থাকা তো কামাইয়ের জন্য। বউবাচ্চা তো সেখানে, শহরে, যেখানে জাহ্নবীর যেতে নেই।
জাহ্নবী ভিজতে ভিজতে বেঞ্চে বসে পা দুলাচ্ছে। কাজরি গাইতে ইচ্ছা করছে। জাহ্নবী কাজরি গাইছে। বিরহের গান। বর্ষা আগুন। জাহ্নবী আগুন নিয়ে খেলেছে আজীবন। পুড়েছে, পুড়িয়েছে। পাঁচিল তুলে ঘর গড়েনি। ভালোবেসে ভেসেছে। ভাসিয়েওছে।
বাজ পড়ল। কানে তালা লেগে গেল জাহ্নবীর। গান থামালো। বৃষ্টির আওয়াজে কান ফেটে যাচ্ছে। শরীরটা মাটির মত গলে শুয়ে পড়ল বেঞ্চির উপর। হাতের লাল কাঁচের চুড়ির গোছা একবার নেচে থেমে গেল। জাহ্নবীর খোলা চোখের সামনে বর্ষা ভাসাচ্ছে প্ল্যাটফর্ম, রেললাইন, মাটি, ঘাস, বন। জাহ্নবীর খোলা চোখ দেখছে না। সে উড়ে আছে অনেক দূরে। ওই আকাশে। দূরে চলে যাচ্ছে তার হৃদয়, তার ভালোবাসা। ওই দেখা যাচ্ছে খানিক আগে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাওয়া সেই ট্রেন। মেঘ বলল, যাবি? সজল হাওয়া বলল, চল। জাহ্নবী বলল, না, সে আসুক। আমি যাব না। আমি যাই না কোথাও। সে আসে। তার শহরে বর্ষা হোক। তার পাকা ছাদের উপর শুকনো কাপড় ভিজুক বারবার। সে বর্ষা কাটিয়ে আমার কাছে ফিরুক। আমি কাজরি গাইব। আমার গান এখনও শেষ হয়নি।
জাহ্নবী মিলিয়ে গেল। সূর্য উঠল। কিন্তু সে পশ্চিমাকাশে পড়ন্ত। গ্রামের লোকে ঘেন্না মেশা দরদে নিতে এলো যাকে, সে জাহ্নবীর দেহ নয়। সে ভেলা। জাহ্নবী রেখে গেছে পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য। সে পার হয়ে গেছে। ভালোবাসার অপেক্ষা থেকে ভালোবাসার মজলিসে। যেখানে কাজরি শেষ হয়েও শেষ হয় না। মাটির জল আবার আকাশে উঠে কাজল মেঘ হয়, জাহ্নবীকে খুঁজবে বলে। প্ল্যাটফর্ম একা একা ভেজে কোনো জাহ্নবীকে নিয়ে, কদমের সৌরভের মত, যে বাতাসে ভেসেও বাতাসের হয় না।