Skip to main content
 
নীল শাড়িটা লোহার বাক্স থেকে বার করে চাঁদের আলোয় বিছানার উপর মেলে ধরল। বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে মেঝেতে মাদুর পেতে। প্রচণ্ড গরম। হোক আশ্বিন, তবু প্যাচপ্যাচে গরম।
      থানটা গা থেকে খুলে নীল শাড়িটা জড়িয়ে শুলো। দূরে সানাই বাজছে। জমিদার বাড়ির পুজো। জমিদার কেউ নেই। পোড়ো বাড়িই বলে লোকে, সবাই কলকাতায় থাকে। এই পুজোর দিনে আসে সবাই, পুজোটা বেশ জাঁকজমক করেই হয়। লোকাল ট্রেনের আওয়াজ আসছে, আপ কৃষ্ণনগর হবে।
      চাঁদের আলোয় তার নীল বেণারসীটা চকচক করছে। সে যেন ছাদনাতলায়। তার সামনে ও। রোগা শরীর। সারা গায়ে যেন মাটির গন্ধ। চোখের চাহনিটা তুষের মত কোমল, উষ্ণ। তার দিকে তাকিয়ে, চোখের নীচে এমন কালো দাগ, যেন কাজল পরেছে। পুরুষ মানুষের চোখ অমন কাজল টানা হয়? ভালোবাসা জন্মায়নি পারুলের, ভরসা জন্মেছিল। ভালোবাসা জন্মাল যখন তখন সে বুঝল। কি করে? যখন সে মাঠে থাকা মানুষটার ঘামের গন্ধ তার ডাল সাঁতলানো ঝাঁঝ ছাপিয়ে পেতে লাগল। উঠানে বেড়াল শুকনো পাতা মাড়িয়ে গেলে মনে হল, বুঝি এসেছে। পারুল বুঝেছিল সে কাজলে ডুবেছে। তার বুকে ভালোবাসার ফসল। বুকে না, পেটে এল।
 
      পারুল উপুড় হয়ে শুলো। তার পিঠের উপর দিয়ে মেলা নীল বেণারসী। ন্যাপথলিনের গন্ধ দেওয়া। কাজলই এনে দিয়েছিল। বলেছিল, তোমার ছেলের বউকে বরণ কোরো। স্বপ্ন দেখত কাজল আর পারুল। সেদিনও জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোর সানাই এত রাত অবধি বাজত। চাঁদের আলো এমনিই তাদের বুক ভাসিয়ে বিছানায় এসে পড়ত।
      অথচ তারা কেউ জানত না, কাজলের চাষের ক্ষেতেই সে বাস করে তার সতীন, কালাচ।
      পারুল বেণারসীটা গায়ে জড়ালো। জানলার গারদ ধরে দাঁড়ালো। সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটায় থরে থরে ফুল ফুটে আছে। তার সিঁথির সব রঙ নিয়ে যেন ও সেজেছে। সামনের মাঠটা চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে, কি শুদ্ধ সাদা রঙ! যেন তার শাঁখাটার সব রঙ সে চুরি করেছে চূর্ণী নদীর পাড় থেকে, যেখানে তার শাঁখা বেড়ে দিয়েছিল কারা যেন। সেদিন মনে হয়েছিল নিষ্ঠুর সব কিছু চারপাশে তার। আজ মনে হচ্ছে ভবিতব্য। সে তো পুতুল, জন্মমৃত্যুর বিধান লেখা কি তোর হাতে পারুল!
      জমিদার বাড়ি 'নৌকাবিলাস' পালা হচ্ছে। রাণাঘাটের পাগলা গোঁসাইয়ের দল গাইছে। বিয়ের আগে সে-ও গাইত এই দলে। তার গলায় রাধারাণীর গান শুনতে কত দূর দূর থেকে মানুষ আসত। বিয়ের পর তার শাশুড়ি দিল সব বারণ করে। বাড়ির বউয়ের ওসব চলবে না। এখন যেমন সে বিধবা বলে কোনো শুভ অনুষ্ঠানে তার যাওয়া চলবে না, শাশুড়ির বিধান।
      পারুল বেণারসীটা গায়ে জড়ালো ভালো করে। বাক্সটা খুলে কাজলের আনা কণ্ঠিটা গলায় পরল। পা টিপে টিপে ঠাকুর ঘরে ঢুকল। চন্দন বাটল অন্ধকারে আন্দাজে। আঙুল ছুঁইয়ে যেই দেখল ঘন হয়ে এসেছে চন্দনের কাই, সে অন্ধকারেই তিলক করল। তাকে ঘিরে এই অন্ধকারই কাজল। এখন আলো অন্ধকার বলে কিছু নেই কাজলকে দেখতে। সে চাইলেই দেখে, তার বুকের আলোয়।
      তার ঘরে এসে বাবলুকে কোলে নিল। সে গুনগুন করে গাইছে, "আমি মথুরা নগরে প্রতি ঘরে ঘরে যাইব যোগীনি বেশে".... এই তো সুর... ভোলেনি তো সে....
      পারুল ঘাসে পা দিল। আশ্বিনের শিশিরে ভেজা ঘাস। তাকে পাগলা গোঁসাইয়ের কাছে যেতেই হবে। সে গেলেই তাকে নেবে। গেলবার ফেরার সময় তাকে ইঙ্গিত করেছিল না? "ঘর যখন দিল না গোবিন্দ তখন পথকেই ঘর কর মা, যাকে ঘরের বাঁধনে পেলি না, তাকে পথের ধুলোয় পাবি"... বলে নি? বলেছে তো।
      শাশুড়ি পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে। উঠান থেকেই প্রণাম করল তাকে, অস্ফুটে বলল, "আমি চললাম মা, নিজের সুখের জন্য না গো, তোমার ছেলের সুখের জন্য, এখানে থাকলে আমি তোমার ছেলেকে চিরকালের জন্য হারাব, তোমার বিধিনিষেধ আমার অন্তঃকরণ বিষিয়ে দেবে, বিষাক্ত ঘরে তোমার ছেলেকে রাখব কি করে বলো? আমার অপরাধ নিও না...."
      একটা কোকিল ডেকে উঠল সামনের আমগাছটা থেকে। পারুল জ্যোৎস্না ধোয়া মাঠের আলোয় মিলিয়ে গেল, কোলে ঘুমন্ত সন্তান। তার ঘরের জানলার গারদ দিয়ে আসা জ্যোৎস্নার আলোয় পুড়ে যাচ্ছে তার খাটের উপর ফেলে যাওয়া সাদা থান।