Skip to main content

বিধান ছ’বছর বয়েস থেকেই বিশ্বাস করেছিল, একদিন সব পাখি ঘরে ফিরে আসবে। সব শাবকদের নিয়ে। উঠান, তুলসীতলা, রান্নাঘরের খুদকুঁড়া সব জানিয়ে দেবে।

বিধানের ঠাকুর্দার মাথাটা খারাপ। মারা যাবার আগে মাথার নার্ভ শুকিয়ে যায়। ব্রেন ছোটো হয়ে যায়। বিধানের ঠাকুর্দার শুকিয়ে যাওয়া ছোটো মাথায় শুধু পাখির ডানার শব্দ, বাড়ি ফেরার শব্দ।

"সব জানলা খুলে দাও, ওরা আসছে…. আমি শুনতে পাচ্ছি, তুমি শুনতে পাচ্ছ দাদুভাই?"

বিধানের বুকের ভিতরটা ধপাস ধপাস করত। ঠাকুর্দার ঘরে বেশিক্ষণ থাকার নিয়ম নেই। এক্ষুনি মা ডাকবে। কিন্তু সে কেন কিছু শুনতে পাচ্ছে না! ঠাকুর্দা পাগল নয়! পাগল নয়!

বিধান আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। কলকাতার সরু গলির মধ্যে এত পাখি রাস্তা চিনে আসতে পারবে? সেই আমাজন, সুন্দরবন থেকে?

 

======

 

বিধান অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে। বাসের শেষ সিটে বসে। জানলার ধারে। সন্ধ্যে হচ্ছে। কলকাতার রাস্তায় আলো জ্বলে উঠছে এক এক করে। আকাশটা হলুদ। ট্রাম লাইনের উপর দিয়ে যাওয়া তারে ফালা ফালা হয়ে আছে। কতক্ষণ অপেক্ষা করলে একটা পাখি দেখা যায়। চোখ জ্বালা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। সব পাখি হারিয়ে যাচ্ছে। ঠাকুর্দা বুঝতে পেরেছিল। ঠাকুর্দা পাগল ছিল না।

 

======

 

বিধানের এই দুঃস্বপ্নটা আগেও এসেছে। সারা পৃথিবীতে একটাও পাখি নেই। ভোরবেলা গ্রামে, জঙ্গলেও কোনো পাখির ডাক নেই। আকাশে কোনো ডানার ঝাপট নেই। কোনো গাছের কোটরে, কি ডালে কোনো পাখির বাসা নেই।

অনেক রাত। বিধান একফালি সরু বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে। ঘরের মধ্যে তার ছোটো সংসার। ঘুমাচ্ছে। স্ত্রী তিতলি আর বাচ্চা, সন্তু, টু এ পড়ে।

বিধান কি পাগল হয়ে যাচ্ছে?

 

======

 

ভোরবেলা। আজ রবিবার। পাখিদের জলের জায়গা করা আছে ছাদে। আর ছোলা, নানারকমের দানা কিছু। কত কম পাখি আসে। বিধান দেখেছে বছরে বছরে পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আজকাল অত তাড়াতাড়ি দানা ফুরায় না।

বিধান সারাটা সকাল ছাদে একা একা থাকে। মাঝে মাঝে সন্তু এসে বসে। সন্তু যেন বুঝতে পারে, বাবার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এক সময় বাবার হাতটা ধরে বলে, নীচে চলো বাবা, মা বকবে।

 

======

 

বিধানের ছেলে নিয়ম করে আসে। বিয়ে করেনি সে। বাবার কথা শোনে। সপ্তাহে প্রতি রবিবার শোনে। একা বসে বসে শোনে। ঘুলঘুলি দিয়ে দিনের আলো এসে পড়ে মেঝেতে। চারদিকে কড়া পাহারা। এখানে কেউ মানসিকভাবে সুস্থ নয়, যদিও সেটা বড় কথা নয়, অনেকে ভীষণ ভায়োলেন্ট, সেটাই বড় চিন্তার বিষয়।

বিধান বড় বড় চোখ করে বলে চলে। পাখি কমে যাওয়ার হিসাব বোঝায়। খাতার পর খাতা সংখ্যা আর কাটাকুটি। শেষে খেই হারিয়ে ফেলে বিধান।

ঠাকুর্দার সারা গায়ে পাখি বসে, স্বপ্ন দেখে বিধানের ছেলে সন্তু। ঠাকুর্দা একটা পৃথিবী বানাচ্ছে। সেখানে শুধু পাখি থাকবে। বিধান গাছের বীজ কিনতে আসে রোজ কলকাতায়। সন্তু গাড়ি করে অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে দেখে। কাঁচ নামিয়ে ডাকে। বাবা চিনতে পারে না সন্তুকে। সন্তুকে বলে, আপনি যাকে ডাকছেন, আমি সে নই, আমরা কেউ কাউকে চিনতে পারব না ক’দিন পরে। পাখির মত মানুষের ভিতর থেকে কি একটা কমতে শুরু করেছে। সেটা কি? সেটা পাখির ডাকের অপেক্ষা। মানুষ সেটা হারিয়ে ফেলছে। খুব খারাপ দিন আসছে। খুব।

 

=====

 

সন্তু খবরটা পেয়েই দৌড়ে এলো হাস্পাতালে। বাবা বারান্দায় কুঁকড়ে শুয়ে আছে। হাতে ধরা একটা মৃত চড়াই পাখি। ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে পড়েছিল কখন, কবে একদিন। তারপর দানাপানি না পেয়ে মরে পড়েছিল এই মেঝেতেই। বিধান নাকি কদিন ধরেই বলছিল "ও মরে যাবে, ওকে ছেড়ে দাও তোমরা… বেরোবার রাস্তা করে দাও।" কেউ শোনেনি। পাগলের কথা কে শুনবে?

বিধানের হার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। আচমকাই। পাখিটা হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিধানকে নিয়ে যাওয়া হল দাহ করতে। সন্তু বলল, পাখিটা আমাকে দিন। মৃত পাখিটা দিল কর্তৃপক্ষ তাকে। পাখিটার নাম কোথাও এন্ট্রি হয়নি বলে দিতে সুবিধা হল, সুপার জানালেন।

 

========

 

সন্তু একা একা ছাদে বসে থাকে। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে বাবার মুখে শোনা বাবার ঠাকুর্দার গল্পের কথা মনে পড়ে। পাখিরা ফিরবে। সবাই ফিরবে। কিন্তু সন্তু কোনো আওয়াজ পায় না আকাশে। পৃথিবীর হৃৎপিণ্ডটা যেন স্লো হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।

সন্তু চোখটা বন্ধ করে বসে। মুখে এসে পড়েছে ভোরের আলো। ছাদের কার্নিশে বসে একটা দোয়েল। যেন সন্তুকে কি বলতে এসেছে। সে ভীষণ শান্ত। বিষণ্ণ।

সন্তু চোখ মেলে তাকালো।

দোয়েলটা তার কাঁধে এসে বসল। সন্তু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পাখিটা উড়ে গেল পশ্চিম দিকে। ধোঁয়ায় মিলিয়ে গেল।

 

সন্তুর চোখে জলের রেখা জন্মালো একটা। বাবার, ঠাকুর্দার চোখের জলের মত।