পরেশের বাবা যে রোগে হঠাৎ চলে গেল, পরেশও গেল সে রোগে। সন্ন্যাসরোগ। পরেশের বউ বাচ্চাটাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল। এখানে থাকলে খাওয়াবে কী আর পড়াশোনাই বা কী করে হবে। পরেশের দিদি পারিজাত একদিন এসে ঘরের পাখাটা খুলে নিয়ে নিজের বাড়ি গেল। বলল, মা তোমার তো তাও গরম সহ্য করার ক্ষমতা আছে। তোমার জামাই একদম পারে না। আর তুমি কারেন্টের বিলই বা দেবে কী করে।
পরেশের মা অন্ধকার ঘরে সন্ধ্যেবেলা দরজার কাছে বসে থাকে। দুপুরবেলা পুকুরপাড়ে বট গাছের নীচে শুয়ে থাকে। সকালবেলা একবাড়ি কাজে যায়। ওরাই খেতে দেয়। রাতে কোনোদিন মুড়ি, কোনোদিন চিঁড়ে। কোনোদিন কিছুই না।
পরেশের মায়ের নাম কী কেউ জানে না। নাম একটা দিলেই হয় - লক্ষ্মী, দুর্গা কিছু একটা। থাক। সবাই যে নামে চিনল সেই নামটাই থাক।
পরেশের মা রাস্তা দিয়ে লোকের বাড়ি ফ্রিজ যেতে দেখে। আশ্চর্য লাগে। ঈশ্বর কী নিয়মে জগত চালায় আজও বুঝল না। কোনোদিন বুঝবেও না। ঈশ্বর যেন লুডো খেলছে। যার ভাগ্যে যে চালটা পড়ে, তার ঘরে সেই ঘুঁটি ওঠে।
যে বাড়ি কাজ করে ওদের বাড়ি এসি আছে। ওরা দুপুরটা থেকে যেতে বলে। খুব ভালো মানুষ ওরা। পরেশের মা থাকে না। বাড়ি ফাঁকা রেখে বাইরে থাকলেই মনে হয়, কেউ যদি এসে ফিরে যায়। এই বারোচোদ্দ বছর কেউ-ই আসেনি। কিন্তু তবু মনে হয় কেউ যদি এসে ফিরে যায়। আসলে অপেক্ষা করে করে অভ্যাস হয়ে গেছে। ছোটোবেলায় বাবার জন্য। বাবা মাছ বিক্রি করত। বিয়ের পর পরেশের বাবার জন্য। সে জুটমিলে কাজ করত। তারপর পরেশের জন্য। সে বাড়ি বানানোর মিস্ত্রির কাজ করত।
পরেশের মা একা একা বসে জানলা দিয়ে রোদ আসা দেখে। সারা বছর ঘুরে ঘুরে রোদ পড়ে বাড়ির এক এক জায়গায়। পরেশের মা তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, এই তো সেদিন পরেশের বাবার সঙ্গে এই বাড়িতে এলো নতুন বউ হয়ে। তার চামড়ার কয়েকটা ধাপ নীচে গেলেই এখনও রক্তে পরেশের বাবার ঘামের গন্ধ, বিড়ির গন্ধ। মানুষ কত কী রেখে যায়।
দুপুরে পুকুরের পাড়ে শুয়ে শুয়ে হাতপাখায় হাওয়া খায় আর লক্ষ্মীর পাঁচালি গায়। শাশুড়ি বলেছিল, বউমা, এইটা কোনোদিন ছেড়ো না। পরেশের মা ছাড়েনি। লক্ষ্মী ছেড়ে গেলেও পাঁচালি ছাড়েনি।
সেদিন পূর্ণিমা ছিল। পরেশের মা রাতে ছাতু আর মুড়ি খেয়ে মেঝেতে মাদুর পেতে শুয়েছে। খুব গরম। শাড়ির আঁচলের দিকটা পেটের কাছে নামিয়েছে। আর নীচের দিকটা হাঁটুর উপর তুলেছে। হঠাৎ জানলার দিকে তাকিয়ে দেখল, কেউ তাকিয়ে আছে। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। তারপর ধড়মড় করে উঠে বলল, কে?
একটু জল হবে? তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। এই যে ইনি আমায় সোগাহ করে বিরিয়ানি গেলালেন। নিজেও গিললেন। এখন….
খিল খুলে পরেশের মা বলল, এসো।
একটা টোটো দাঁড়িয়ে। যে চালাচ্ছে তাকে চেনা মনে হল। রাতে ভালো চোখ সাথ দেয় না। মেয়েটা কী সেজেছে। গা থেকে উৎকট গন্ধ বেরোচ্ছে। মদের।
জলের বোতলটা এগিয়ে দিল। সামনের টাইমকলের জল। পরেশের মা বিকেলে ভরে আনে। দুই বোতলে হয়ে যায়। আজ একটা আগেই শেষ হয়ে গেছে। খুব গরম না আজ!
মেয়েটা ঢকঢক করে অর্ধেক জল খেয়ে নিল। তারপর বাইরে গিয়ে টোটোর লোকটাকে বোতলটা দিয়ে আবার ভিতরে এলো। বলল, তোমার ঘরে কারেন্ট নেই? এদিকে পাকা বাড়ি! আশ্চর্য! তুমি একা থাকো? ও অবশ্য বলছিল তোমার নাকি ছেলে ছিল।… ওই বলল, তুমি অনেক রাত অবধি জেগে থাকো নাকি। আর নাকি দারুণ গান গাও!
ছি ছি! সব শুনেছে নাকি! একবার আড়চোখে তাকালো টোটোর পুরুষ মানুষটার দিকে। তার গান শুনেছে? তার গানের গলা ভালো। নিজেও জানে। কিন্তু কেউ এমনভাবে আড়ালে কদর করে আগে জানত না তো!
মেয়েটা বলল, বয়েস থাকলে তোমায় নিয়ে যেতাম…. কিন্তু তাও যদি যেতে চাও তো যেতে পারো…. যাবে? গাঁজাতলার মোড়ে গিয়ে বলবে, বুড়ো দীঘির দিকে যাব। সবাই বুঝে যাবে। খারাপ পাড়া! যাবে?
মেয়েটা নেশায় চুর হয়ে আছে। পরেশের মা নিজের রাগ হবে ভেবেছিল। হল না। মেয়েটা তার গালে একটা চুমু খেয়ে চলে গেল। বলে গেল, এসো। নইলে আমিই আসব। গান শুনতে, কেমন? ফাঁকা বোতলটা দিয়ে গেল। চাঁদের আলোয় একটা মস্ত ছায়া তৈরি করেছে ফাঁকা বোতলটা, চিড় ধরা দেওয়ালে।
ঘুমিয়ে পড়ল পরেশের মা। দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ল।
পরেরদিন সকালে মেয়েটার গায়ের আতরের গন্ধ ছিল ঘর জুড়ে। সন্ধ্যেতেও ছিল। তার পরেরদিনও ছিল। সুখের গন্ধ। দুদিন পর গন্ধটা চলে গেল। পরেশের মায়ের মনে হল আবার সে একা হচ্ছে। একা!
একদিন কাজের বাড়িতে দুপুরে খাচ্ছে। ও বাড়ির ছেলেটা বলল, মাসি আমরা সব কাশী যাচ্ছি সামনের মাসে। যাবে নাকি? বলো তো টিকিট কাটি। যাবে?
পরেশের মায়ের মনটা কঁকিয়ে উঠল। কাশী গিয়ে কী করবে? একাই তো হবে আরো। তাছাড়া এই ভজনতলা ছেড়ে গেছে নাকি কোথাও? একবার তারকেশ্বর গিয়েছিল মনে আছে। বাবুর মাথার চুল দিতে।
পরেশের মা এঁটো তুলতে তুলতে বলল, গাঁজাতলা কোনদিকে জানো ভাই?
কম্পিউটারের থেকে চোখ সরিয়ে ছেলেটা বলল, সেখানে কে থাকে?
পরেশের মা বলল, আমার এক বোনের মেয়ে। খুব করে বলেছে যেতে। তোমরা কাশী গেলে ভাবছি আমি কদিন ওর ওখানে থেকে আসব।