Skip to main content

"শনি-মঙ্গলবার বিষ হয় এই সাপের। দেখো আজ শনিবার। বাজে ভাবে কামড়েছে। কিন্তু ঠিক জায়গায় এসে পড়েছ। কিচ্ছু হবে না। সব ঠিক করে দেব। তুমি ওকে শুইয়ে দাও মাটিতে। আমি আসছি।"

ওঝা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। বাইরের মন্দিরে একটা প্রদীপ জ্বলছে। মেঝেতে শুয়ে আছে মনা। মিটমিট করে তার দিচ্ছে তাকাচ্ছে। হাসছে। একবার বলল, দাদা, এই ওঝা কি খুব রাগী? আমায় কি ঝাঁটার বাড়ি মারবে?

সুকান্ত বলল, ধুর! একটা তিতা কি বেটে আনবে, ঠিক হয়ে যাবি। আরে জলঢোড়া আমরা কত নিয়ে খেলেছি। আজ শনিবার বলেই তোকে নিয়ে এলাম এখানে। নইলে থোড়াই আনতাম!

========

বোন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। ওই তিতা ওষুধ খেয়েই। কতদিন আগের ঘটনা। এখন মনারই দুটো মেয়ে। সুকান্ত থ্রি টায়ারের সাইড আপারে শুয়ে শুয়ে এইসব ভাবছে। তাকেও গত মাসে যখন কুকুরে কামড়ালো, বাড়ির লোকে বলেছিল হাস্পাতালে গিয়ে ভ্যাক্সিনটা নিয়ে নিতে। নেয়নি। নেবেই বা কেন? বিষ ঝাড়াতে গিয়েছিল সুনীল দাদুর বাড়ি। কত লোক হয় শনি-মঙ্গলবারে! গাড়ি করেও লোক আসে। আর এ তো সামান্য কুকুরের বিষ।

কিন্তু জ্বরটা কেন এল বুঝতে পারছে না সুকান্ত। মাথাটাও ধরে আছে। ঠাণ্ডা লাগল কি? সর্দি বা গলা জ্বালা তো নেই। সুকান্ত উঠে বসল। সবাই ঘুমাচ্ছে। যশবন্তপুর এক্সপ্রেস। ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছে। ওখানেই কাজ করে। মিস্ত্রীর কাজ। পয়সা আছে। ছেলেটা সেভেনে উঠল। দেখতে দেখতে মাধ্যমিক এসে যাবে। টাকা তো লাগবেই। ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো। ভালো রেজাল্ট করে। গর্ব হয় সুকান্তের। সে নিজে তো ফাইভের বেশি পড়েনি। কবে থেকে বাইরে বাইরে। আগে ছিল কাশ্মীরে।

========

ট্রেনে জ্বরটা বাড়ল। পরের দিন। কামড়ানো জায়গাটা জ্বালা জ্বালা করছে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন ঘাড়ে, আঙুলে, কোমরের কাছটায় কে সূঁচ ফোটাচ্ছে। কয়েকবার টয়লেটে গেল। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে আঙুলটা কেঁপে উঠল। চোখটা কেঁপে উঠল। কি হচ্ছে? এটা কি কুকুরে কামড়ানোর জন্য? কয়েক ঢোক জল খেল। কিচ্ছু হচ্ছে না। তবে তো জলাতঙ্ক নয়। অন্য কিছু হবে।

========

ব্যাঙ্গালোরে পৌঁছে জ্বরটা ছেড়ে গেল। কিন্তু মাথা ধরাটা থেকে গেল। আর গায়ে এখানে ওখানে কাঁটা বেঁধার মত কি একটা।

সুকান্তকে নিয়ে হরেন বোস সমস্যায় পড়ল পরের সপ্তাহ থেকে। কি অদ্ভুত ব্যবহার করতে শুরু করেছে! পাগলামি করছে। এর-ওর দিকে তেড়ে আসছে। পাখা চালাতে দিচ্ছে না, বলছে দমবন্ধ হয়ে মরবে! জল খেতে পারছে না। জল দেখলেই কেমন একটা করছে।

হরেন বোস বাড়িতে ফোন করে সবটা জানল। এ তো জলাতঙ্ক! ভ্যাক্সিন দাওনি তোমরা?

না দাদা, ও তো থালাপোড়া করেছিল…. থালা দাঁড়ায়নি দাদা, উপরের দিকে উঠে যাচ্ছিল। থালা দাঁড়ালে তো বিষ।

বাল….

========

টিটি তিন হাজার টাকা বলেছিল। হরেনের চেনা। অনেক বলে কয়ে দুই হাজারে রাজী হল।

ট্রেন ইয়ার্ডে থাকতেই হরেন সুকান্ত আর দু'জন লেবারকে নিয়ে চলে গেল। সুকান্ত'র হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে ট্রেনের টয়লেটে হরেন নিয়ে বসে থাকল। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দিতে দেরি আছে এখনও। তারকেশ্বরে পাঁচশো এক টাকা মানত করল হরেন, যদি এ রুগী ভালোভাবে নিয়ে যেতে পারে তো নিজে গিয়ে পুজো দিয়ে আসবে।

হরেনের আতঙ্ক লাগছে। ইতিমধ্যে দু'জনের দিকে ধেয়ে গেছে সুকান্ত কামড়াবে বলে। পারেনি। রতন তো সামনে রাখা সসপ্যানটাই মুখে মেরেছিল সুকান্তের। চোখের নীচে কাটা দাগ পড়ে গেছে। আর ভীম ধাক্কা দিয়ে পালিয়েছিল।

সুকান্ত গরগর করছে। যা খুশী কর বাবা, হেগেমুতে রাখ। কোনোমতে হাওড়া চল। তারপর চন্দনকে বলা আছে ও চারশো সাত নিয়ে আসবে। উঠিয়ে নিয়ে চাকদা তোর বাড়ি অবধি গেলেই শান্তি।

========

ট্রেন ছাড়ল। হরেন টয়লেটের সামনে বসল। টিটি বলেছে পরের টিটিকে বলে দেবে। ক্যাঁচাল হবে না।

যে-ই এই টয়লেটে আসছে হরেন হাতজোড় করে বলছে, দাদা পাগল আছে…. গরীব মানুষ… নিয়ে যেতে দিন। আপনাদের ভদ্রলোকেদের সঙ্গে তো নিয়ে যাওয়া যাবে না… কি গালিগালাজ করে বসে। হেগেমুতে লাট করে।

হরেনের বলতে বলতে গলা শুকিয়ে এসেছে। এক-একবার মনে হয়েছে রাতে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেয়। কিন্তু ঊর্মি আর ছেলেটার জন্য মনটা সায় দিচ্ছে না। নইলে এ মাল এমনিও মরবে, অমনিও।

মাল!

========

নিজের কানে বাজল শব্দটা। সুকান্ত ভালো ছেলে ছিল। কোনো বাজে নেশা করত না। ভদ্রছেলে। কোনোদিন একটা খারাপ কথাও শোনেনি ওর মুখে। কাকা ছাড়া কথা বলত না।

হরেনের মনটা টাটালো। ঘুমিয়ে পড়েছিল টয়েলেটের দেওয়ালে মাথা রেখে। হঠাৎ মনে হল ডাকছে তাকে সুকান্ত…. কাকা তেষ্টা পেয়েছে।

হরেন উঠে টয়েলেটের দরজাটা খুলল। পায়খানার প্যানে উল্টে পড়ে আছে। হাতটা পায়খানার ফাঁকা জায়গা দিয়ে ঢোকানো। হরেনের বুকটা শুকিয়ে গেল। ট্রেনটা ভীষণ জোরে চলছে। লেট দু'ঘন্টা যদিও। হরেন সুকান্তের কাঁধে হাত দিয়ে ঘোরাতেই মাথাটা এলিয়ে পড়ল দরজার দিকে। ভোরের আলো এসে পড়েছে সুকান্তের মুখের উপর। সুকান্ত খোলা দুটো চোখ তার দিকে তাকিয়ে। মরে গেছে।

========

হাওড়ায় শুরু হল হুজ্জুতি। হুলুস্থূলু পড়ে গেছে। ভিড় আর ভিড় চারদিকে। যেন মড়া মানুষ দেখেনি এরা আগে কেউ। এদের বাড়িতে যেন কেউ মরেনি। পুলিশ এলো। হাজার একটা প্রশ্ন। বডি পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে যাবে। যাক। সে তো যাবেই। তার আগে মানুষের প্রশ্নের শেষ নেই। কি করে হল… কি হয়েছিল… কেন হল…. ডাক্তার দেখিয়েছে কিনা…

হরেন কারুর প্রশ্নের উত্তর দিল না। চুপ করে বসে থাকল। যেন বাবার থানে এসেছে। বাবা সবার কথা শুনছে, উত্তর করছে না। মাঝে মাঝে ঈশ্বরের মত পাথর আর হাপিশ না হলে টেকা যায় না জগতে। ক্রমে ভিড় কমল। একটা গলির মধ্যে সুকান্তকে শুইয়ে রেখে চলে গেল অফিসারেরা। কি সব কাগজ হবে। দেরি লাগবে। হরেন বসে আছে সুকান্তের মাথার কাছে। সুকান্ত তাকিয়ে আছে। যেমনভাবে জীবন্ত মানুষ তাকায়।

পুলিশ জিজ্ঞাসা করল, কে হয় তোমার?

হরেন কিছুক্ষণ ভেবে পেল না কি উত্তর দেবে। কে হয়? মুখটার উপর মাছি বসছে। খোলা চোখ দুটো প্ল্যাটফর্মের ছাদ দেখছে। ছাদে পাখির বাসা। অনেকক্ষণ ধরে হরেনও তাই দেখছিল। গোটা সংসারে যেন সে আর সুকান্ত দুটো জোকার। সার্কাস চলছে। একজন মড়ার অভিনয় করছে, আরেকজন জ্যান্তের।

কালা নাকি… কে হয় তোমার?

হরেন বলল, ভাইপো…..

হরেন দাঁড়াতে পারল না। এই প্রথম পেট নিংড়ে কান্না পেলো। শ্মশানের কান্না। যে কান্নায় দেওয়াল হয় না। আড়াল হয় না। হরেন কাঁদতে কাঁদতে বুঝল, গলা শুকিয়ে কাঠ…. জলতেষ্টা পেয়েছে…. জল….