সৌরভ ভট্টাচার্য
12 February 2020
আমরা সারা জীবনে ক'টা খুন নিজের চোখে দেখেছি? আমি যত মানুষকে এতটা জীবন ধরে জানি কাউকে শুনিনি সে নিজে একটা খুন হতে চোখের সামনে দেখেছে। আমরা খুনের কথা খবরের কাগজে পড়ি, খবরে দেখি।
আমি 'জোকার' আর 'প্যারাসাইট' দুটো সিনেমা পর পর দেখলাম। এই কথাটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, সিনেমায় কি আজকাল এই দৃশ্যগুলোর সংখ্যা বাড়ছে? একটা খুনকে যতটা সম্ভব বাস্তব করে দর্শকের চোখের সামনে রাখতে হবে?
যদিও যে দুটো সিনেমার কথা উল্লেখ করলাম দুটোই সিম্বলিক গল্প। তবু রক্ত এসেছে। মৃত্যুর বীভৎস চিত্রায়ণ এসেছে। অভিনয়ের উৎকর্ষতা ইত্যাদি যদিও আছে, কিন্তু বড় বেশি মাত্রায় আছে বলে আমার বোধ হয়েছে। দুটো সিনেমাই প্রতিবাদের গল্প। সিস্টেমের বিরুদ্ধে, সমাজের স্বার্থপরতা, বৈষম্য, নির্মমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গল্প। যদি ইন্টেলেকচ্যুয়ালি দেখি, তবে দুটো সিনেমার চিত্রনাট্য, অভিনয়, গল্পটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে সাজানোর কৌশল অসামান্য লাগবে। সংলাপও অসামান্য। ধাক্কা দেবে, একটু অন্যভাবে ভাবাবে। জোকার যেখানে নির্দয়তা, এক শ্রেণীর সব কিছুর মাত্রা ঠিক করে দেওয়া, শোষণ, নানাভাবে এক্সপ্লয়েট করা সমাজের উদাসীনতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার গল্প, তেমন প্যারাসাইট-ও সামাজিক বৈষম্যকে নির্মমভাবে চিত্রায়ণের গল্প। সে প্রতিবাদ অবশেষে হিংস্র হয়ে উঠছে, অবশেষে ধ্বংসাত্মক হত্যালীলায় যেন এর সমাধানের পথ খুঁজছে। এইখানেই আমার প্রশ্নটা, হঠাৎ করে আমরা কি সবাই এমন ধারা ভাবনাটাকেই রাস্তা বলে মেনে নিচ্ছি তবে?
সিনেমা দুটোতে যে সমস্যার কথা বলা হয়েছে সে সমস্যা সমাজের আদিম সমস্যা। নানা সময়ে নানা নীতির মাধ্যমে তার সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা হয়েছে, এখনও হয়ে চলেছে। পরিবর্তন হয়েওছে, আবার হয়নিও। অসহিষ্ণুতা সেদিনও ছিল, আজও আছে। আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোই প্রমাণ করে দেয় আমরা মূলগতভাবে কতটা অসহিষ্ণু একে অন্যের ওপর। কিন্তু তার সমাধানের পথ কি এমনই একটা ধ্বংসাত্মক চিন্তায়?
আজ সারা পৃথিবী জুড়ে মেরুকরণের গল্প। আমাদের দেশ থেকে শুরু করে কিম, পুটিন, ট্রাম্প হয়ে যে ছবিটা শাসনের আসে, সে ছবিটা মেরুকরণের। একটা পক্ষকে মেনে নিয়ে অন্যপক্ষকে ‘অন্য’ করে দেওয়া। সারা পৃথিবীজুড়ে একটা সরলীকরণের রাস্তা খোঁজার চেষ্টা – 'ওরা তো না থাকলেই হয়'। বিদ্বেষ এখন যেন একটা রিপু নয়, বিদ্বেষ একটা নীতি হয়ে উঠতে চাইছে। বিদ্বেষও যেন নিজের মধ্যে নিজের একটা জাস্টিফিকেশান খুঁজে নিতে চাইছে। আমাদের সমর্থন চাইছে। সে বলতে চাইছে, ‘তুমি কি যুগ যুগ ধরে শোষিত নও? উৎপীড়িত নও? তুমি কি বারবার হেরে যাচ্ছ না সমাজের পক্ষপাতদুষ্ট নীতির কাছে? সমাজের ঔদাসীন্য কি তোমায় তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে না? এই সামাজিক হায়ারার্কিতে তোমার উন্নতির পথ কোথায়? তুমি তো ক্রমে নীচের দিকে নেমেই যাচ্ছ, নেমেই যাচ্ছ, নেমেই যাচ্ছ।‘
খুব সত্যি কথাগুলো, ভীষণ সত্যি কথা। সমাজের এক বিশাল অংশের রাগ-ক্ষোভ-দ্বেষ সব এই কথাগুলোকে সমর্থন জানাবে। বলবে, তাই তো, এই কথাগুলোই তো আমাদের রাত-দিন কুরে কুরে খাচ্ছে। কিন্তু উপায় কি? বিদ্বেষ তখন বলবে, আমায় সারথি করো, আমি দেখাব পথ। আমি যেমন লঙ্কায় আগুন ধরিয়ে রাস্তা বানাতে বলেছিলাম হনুমানকে তোমায় ঠিক সেরকম রাস্তা দেখাব। মনে রাখতে হবে না সেই লঙ্কায় সীতাও আছেন। ওরকম অনেক সীতাকেই পুড়ে যেতে হয় আমার আগুনে। সীতা থেকেও এতদিন কি লাভ হচ্ছিল তোমাদের বলো?
তবে কি আমাদের মনের মধ্যে জমা এই চরম অসহিষ্ণুতাই শিল্পের মানদণ্ড বিচারের পরাকাষ্ঠা হবে? সিনেমা দুটোই বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফল। মানুষের মধ্যে জমে থাকা এই বিদ্বেষের ক্ষোভের আগুনই তবে আমার সৃষ্টির উদ্দেশ্য। তাকে বাইরে আনা, তাকে বলা, হ্যাঁ এ-ও একটা পথ হতে পারে, তুমি ঠিকই ভাবছ। যদিও তোমার ভাবনাগুলো এতদিন গোপনে ছিল, দেখ আমি সেগুলোকেই শিল্পের বৌদ্ধিক উৎকর্ষতায় সাজিয়ে তোমার সামনে আনছি, তুমি হাত পেতে চেটেপুটে খেয়ে নাও দিকিনি।
তবে এর অর্থ এই নয় যে আমি মনে করি এই ধরণের সিনেমা দেখালে মানুষ তথাকথিতভাবে ‘ভায়োলেন্ট’ হয়ে যাবে, সমাজ উচ্ছন্নে যাবে ইত্যাদি, এগুলো শিশুসুলভ যুক্তি। আমার কথা অন্যখানে, মানুষের মনে অনেক বৃত্তি আছে। মানুষের ইতিহাস নানা মাত্রার ইতিহাস। মানুষের সমাজ জটিল, কারণ মানুষ নিজে জটিল। মানুষের সমাজে অসাম্য, শোষণ, অত্যাচার, অবিচার আছে, কারণ মানুষের মধ্যে এই সবগুলো আছে। মানুষ সভ্য হলেও বর্বর, মানুষ শহুরে হলেও তার মধ্যে জঙ্গলের আইন এখনও মুছে যায়নি। কোনোদিন মুছবে বলে বিশ্বাস করি না। তবু এর মধ্যে মানুষ তার মানবিকতার প্রদীপটাকে জ্বালিয়ে রাখছে। ভাবুন তো সেই দৃশ্য, সর্বজয়া খেতে বসেছে, ইন্দির ঠাকরুণ ক্ষুধার্ত হয়ে তার দাওয়ায় তার মাখা ভাতের দিকে তাকাচ্ছে। সর্বজয়া মুখ ফিরিয়ে খেতে শুরু করল, উপেক্ষা করল ইন্দির ঠাকরুণের খিদে। ইন্দির ঠাকরুণের মুখে বিষণ্ণতা। ইন্দির ঠাকরুণ যদি ঝাঁপিয়ে সামনে রাখা বটি দিয়ে সর্বজয়ার গলা কেটে দিত, কিম্বা উল্টোটা হত? সারা উঠোন জুড়ে রক্ত বয়ে যাচ্ছে, আপনি দেখছেন। কিম্বা 'খারিজ' সিনেমায়, শেষে সদ্য বন্ধ রান্নাঘরের মধ্যে মারা যাওয়া গরীব কাজের বাচ্চাটার বাবা তার মালিকের ওপর চড়াও হয়ে খুনোখুনি করছে? তা হয় না তো! আর হলেও সেইটা মানুষের সমাজের গপ্পো নয়। তবে এত কিছুর পরেও মানুষের এই অগ্রগতিটা হত না। আমি ততটা সিনিক কিছুতেই হতে পারি না। ততটা সিনিক হওয়া রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – পাপ, 'সভ্যতার সংকট'-এ যা বলেছিলেন।
তবে আজ এই দর্শনকে, এই বিদ্বেষের আগুনকে এমন শিরোপা কেন? সে যদি শ্রেষ্ঠত্বের আসন পায়, তবে যারা এই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়েও, আরো অন্ধকারের রাস্তায় না হেঁটে টিমটিম করে আলো জ্বালিয়ে রাখতে চাইছে তাদের গল্পগুলোকে কি হারিয়ে দেব? বলব তোমরা নেহাতই ইউটোপিয়ান? কল্পনা? কিন্তু সেদিনের গুহা থেকে আজকের রাজপথ অবধি এই রাস্তাটা তো কল্পনা করেছিল বলেই তৈরী হয়েছিল। ‘তবু’ শব্দটাতেই তো মানুষের এগোনোর সঞ্জীবনী। অন্ধকারের উৎসবে যে মাতি, ধ্বংসের উল্লাসকে যদি জয়তোরণ ঘোষণা করি, তবে সামনে যে আরো আরো অন্ধকারের যুগ। আমার আপত্তি এক জায়গাতেই, আমরা যেন অন্ধকারের সেলিব্রেশান না করি। আমরা যেন আলোকেই সামনে এগিয়ে দিই, বাস্তব জগতে ততটা না পারলেও অন্তত আমাদের সৃষ্টিগুলোতে। আমাদের শিল্পে, বিশ্বাসে। এমন অন্ধকার, মৃত্যু আর ধ্বংসের পতাকা নিয়ে হিংসাকে যেন না বলি, তুমিই আজ থেকে হও আমাদের কল্পলোকেরও কাণ্ডারী। আমরা অন্ধকারের ছবি আঁকি, হত্যায় মেতে গিয়ে, আলোর গল্প আমাদের আজ ইউটোপিয়ান ধারণা।