সৌরভ ভট্টাচার্য
23 June 2020
মারাঠি সিনেমা। আমাজন প্রাইমে আছে, নাম JOGWA। বিষয় - দেবদাসী প্রথা, যৌনতা - লিঙ্গান্তরের সামাজিক অবস্থান। কেমন সিনেমা? আন্তর্জাতিক স্তরের কিনা? ভুলে যান। আমি সে কথা বলতে লিখছি না।
আমি বলতে চাইছি আমাদের ভুলে যাওয়া সেই ঐতিহ্য মণ্ডিত গর্বিত প্রথা নিয়ে। কিরকম ছিল তাদের জীবন? কত মানুষের লালসা, ভোগের বস্তু হয়ে ফিরতে হত, মনে নেই? বেশিদূর যেতে হবে না, এমনকি 'নীলাচলে মহাপ্রভু' সিনেমার সেই দেবদাসীর কথা মনে নেই? যার গৃহে অনায়াস বিচরণ ছিল মন্ত্রীর? যাকে অনায়াসে রাজকাজে ব্যবহার করে ফেলা যায়, মনে নেই অভিসারের মোড়কে মহাপ্রভুর ঘরে রাতে পাঠানোর গল্প? মনে না থাকারই কথা। দেবদাসীরা তো সব সময় পার্শ্বচরিত্র। বেণারসের অল্পবয়েসী বিধবাদের জীবন নিয়ে 'ওয়াটার' বানাতে গেলে আমাদের দেশে তো শুটিং করা যায় না। শ্রীলঙ্কায় যেতে হয়েছিল না? কারণ আমরা ওসব ব্যভিচারিতা প্রকাশ্যে সহ্য করতে পারি না। আমাদের চিন্তা-ভাব কলুষিত হয়।
আজকের দিনেও কারোর মনে পড়ে না, কতগুলো মেয়ের জীবন কিভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। এত এত পোস্ট সামাজিক মিডিয়ায় আজ। কিন্তু ওরা আজও ব্রাত্য। আজকের জেনারেশন তো জানেও না অনেকেই কি হত সেদিনের দেবদাসীদের সাথে সমাজে। বরং আমায় সূর্যগ্রহণের ঐতিহ্য নিয়ে জ্ঞান শুনতে হয়। মেসেঞ্জার ভরে যায় অন্ধযুক্তিতে। যাদের মধ্যে অনেকেই আবার নানা বিশ্ববিদ্যালয় পাশ উচ্চশিক্ষিতা মহিলা। আমার খুব প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, আমি তো মহিলা নই, তাই আমার অনুমানের, কল্পনার সীমাবদ্ধতা থেকেই যাবে। আপনাদের কখনও মনে পড়ে সেই নানাভাবে ব্যবহৃতা দেবদাসীদের কথা? তাদের কান্না, তাদের অসহায়তা? মনে পড়ে সেই বাল্যবিধবাদের নানা করুণ কাহিনীগুলো? রাগ হয়? কান্না পায়? অসহায় লাগে? প্রায়শ্চিত্ত করতে ইচ্ছা হয় তাদের স্মরণ করে? জ্যান্ত চিতায় তোলা, ভ্রূণ নষ্ট করার জন্য প্রাণসংশয়ী নানা গ্রাম্যপ্রথায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া? মনে পড়ে? কোনো একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি দুদিন আমায় জ্ঞান দিচ্ছিলেন বাড়ির শান্তির জন্য অনেক কুসংস্কার মেনে নিতে হয়। আমার করুণা হয়েছিল। কারণ সেদিনও বাড়ির শান্তির জন্য, সমাজের শান্তির জন্য মহিলাদের অনেক কিছু মেনে নিতে হত নাকি। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন না, কেন শুধু মহিলারাই? কেন মোক্ষর পথে বাধা শুধু 'কামিনী' রাই? আপনি প্রশ্ন করতে পারেন না, কেন অবতারের সমাজ এত পুরুষ শাসিত? আপনি প্রশ্ন করতে পারেন না কেন দেবীর মুখ লজ্জায় ঢেকে দেওয়া হয় কারণ তিনি ঋতুমতী বলে আজ থেকে। কিসের লজ্জা? কেন অশুচি তিনিও এই সময়ে? কারণ দেবী হলেও তিনি পুরুষের সমাজের দেবী।
অনেক অনেক প্রশ্ন জমে। করা যায় না। ভক্তি বিহ্বলতায় সব ভুলে যেতে হয়। কারা যেন গরীব অভুক্তকে খিচুড়ি খাইয়েছিল, তাই তারা যাই করুক না কেন ভালো বলে যেতে হয়। সে যে কোনো কুসংস্কারকে মান্যতা দিলেও বলে যেতে হবে নাকি, আহা তুমি মহান।
আমার মন শান্ত হয় না। ইতিহাস উলঙ্গ নাচ নাচে সামনে। সেই ইতিহাসের বাছা কয়েকটা পাতা এনে যদি আমার সামনে এনে বলো এই হল সবটা, আমি তোমায় বলব তুমি মিথ্যুক। আমি প্রাণপণে বাকি পাতাগুলো খুঁজে যাব, তাদের অসহায় কান্নাগুলো খুঁজে এনে বলব, একেবারে ভুলে যেও না.... একদিন হিসাব দেখাতে পারবে না..।