ইলা মৃত্যুর পর কাশী চলে এলো। বিরাশি বছরের হাত-পা-বুক-মাথা-পেট ছেড়ে আসতে ব্যথা পেল কই? বাড়ির লোকের কান্নার মধ্যেও ছিল স্বস্তির সুর। ইলা বাড়ির সামনের উঠানে কিছুক্ষণ বসে তাদের কান্না শুনতে শুনতে বলেছিল, শালা! তারপর চলে এলো সটান কাশী।
বাড়ির লোকেরই বা দোষ কি, পাঁচ বছর বিছানায় পড়েছিল। গায়ে পোকা হয়ে যাচ্ছিল শুয়ে শুয়ে। মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা পরে সব চা নিয়ে বসল। স্বাভাবিক মৃত্যুতে চা বসে যায় উনুনে। আকস্মিক মৃত্যুতে চা হয় না। মাতাল বড় নাতিটা মরল যেবার বাইক অ্যাক্সিডেন্টে, দুদিন চা পায়নি। চা তেষ্টায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। শেষে ওষুধ কেনার আছিলায় গিয়ে চা খেয়ে আসতে হয়েছিল।
চা তেষ্টা পাচ্ছে আবার। ইলা একটা দোকানের পাশে দাঁড়ালো। এক বুড়ো বেঞ্চে চা রেখে খবরের কাগজ পড়ছে। সুড়ুৎ করে একটানে চা'টা টেনে নিল ইলা। তারপর বেঞ্চে পা ঝুলিয়ে বসল। বায়বীয় পা। যেই না কাগজ সরিয়ে বুড়ো চায়ের ভাঁড়ে হাত দিয়েছে, সে তো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে গঙ্গার হাওয়া লেগে এতক্ষণে, বুড়ো চমকে উঠে, ক্ষেপে গিয়ে বলল, কৌন পিয়া রে মেরা চায়ে….
ইলা কানে বায়বীয় মুখ এনে বলল, হামি রে বুকাসুদা….. চা ঠাণ্ডায় জুড়িয়ে যাচ্ছে… উনি কাগজ পড়ছেন…. ন্যাকামি!
=====
ইলার জন্ম বাংলাদেশে। দেশভাগের পর এ দেশে আসে। কলেজ পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়। কাঁকিনাড়ায় বাকি জীবন। স্বামী ছিল রেলের ফোরম্যান। বড় খিটখিটে মানুষ ছিল। সুখ যেন মাছির মত, রাতদিন তাড়াত। আর দুশ্চিন্তা যেন পোষা কুকুর, রাতদিন সঙ্গে নিয়ে বেড়াচ্ছে, সেও লেজ নাড়ছে, ইনিও তোয়াজ করে যাচ্ছেন।
বিয়ের পর পুরী যাবে প্রথম। ইলার ইচ্ছা পূর্ণিমায় যাবে। পূর্ণিমায় সমুদ্র দেখবে। হল না। কারণ স্বামী হিসাব করে জানাল সেই সময়ে ইলার মাসিকচক্র শুরু হওয়ার সময়, অগত্যা পুরী গিয়ে মন্দিরে যাওয়া যাবে না। আর মন্দিরে না গেলে আর পুরী যাওয়া কিসের।
ইলা বলল, হ্যাঁ গো… ওই অতবড় সমুদ্র তোমার কাছে কিছু নয়… ওই নিমকাঠের তিনটে পুতুলেই তোমার এত সাধ!
খিস্তি করেছিল বিভাস তাকে। বলেছিল যেমন বাবা, খানকি তেমনই মেয়ে হয়েছে, নাস্তিক।
কথাটা মিথ্যা বলেনি, ইলা আর তার বাবা রমেন নাস্তিকই ছিল। সে অন্য কথা, পরে আসছি।
পুরী তো যাওয়া হল, অন্য সময়ে। ওমা! সে তো সমুদ্রেই নামে না। আগে বলল, সমুদ্রের জলে অ্যালার্জি। পরে বলল, ঢেউতে শ্বাস আটকায়। ইলা বেশ কয়েক বছর পর বুঝেছিল, আসল কারণ গায়ের রঙ। অমন দুধে আলতা রঙ যদি কালো কয়লা হয়ে যায়!
ইলার করুণা হয়েছিল। ইলার মনে হয় কাম আর করুণা ছাড়া সংসারে আর কোনো বন্ধনে সে তার স্বামীর সঙ্গে জড়ায়নি। শেষে যেটা ছিল ওটা ভালোবাসা না, অভ্যাস। অনেকদিনের আঁচিল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা যেমন তর্জনীর অভ্যাস হয়ে যায়, এও সেই।
====
ইলার বাবা দেশভাগের সময়, ওই পৈশাচিক বীভৎসতায় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। মানুষ এত নির্মম হতে পারে! বারবার বলত, যে ঈশ্বর এই বীভৎসতার সাক্ষী থাকতে পারে, হয় সে নেই, নয় সে শয়তানের থেকে খুব আলাদা কিছু নয়, অতিরিক্ত চালাক হবে।
ইলা বাবার থেকে তিনটে জিনিস পেয়েছিল। নাস্তিকতা, হোমিওপ্যাথি আর কবিতা লেখার শখ।
নাস্তিকতা
=======
বিভাস, শ্বশুর শাশুড়ি সবাই রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত। ইলাকে অনেক পীড়াপীড়ি করলেও ইলা নেয়নি। রীতিমতো অত্যাচার হয়েছে, ইলা বলেছে, না। না তো সন্ধ্যে দিয়েছে, না অষ্টমীর অঞ্জলি। তবে ইলার ব্যক্তিত্বে এমন একটা স্বচ্ছতা ছিল যে ধীরে ধীরে সবাই ইলাকে ইলার মত করেই মেনে নেয়। ভালোবাসা না পেলেও দ্বন্দ্বে নামেনি কেউ আর তার সাথে। স্বচ্ছতা যে সংসারে বড় দুর্মূল্য বস্তু সেটা নিজেদের দিকে তাকিয়েই হয় তো বিভাস আর তার বাড়ির লোক বুঝেছিল।
হোমিওপ্যাথি
===========
ইলার কাছে বেশিরভাগ রুগীই আসত মহিলারা। কারণ ছিল নানা গুপ্তরোগ। ইলার বেশ নামও হয়েছিল এই চিকিৎসায়। প্রায় সত্তর বয়েস অবধি রুগীও দেখেছে ইলা।
ইলা খেয়াল করেছিল মহিলাদের গুপ্তরোগের সঙ্গে অনেক গুপ্ত গল্পও থাকে। তাই চিকিৎসাটা শুধু রোগের না, গল্পেরও করতে হত। সংসারে এত আড়াল, এত পর্দা, এত কানাকানি ইলার আশ্চর্য লাগত যে এসবের মধ্যেও তার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে না কেন। ইলা পাপে বিশ্বাস করেনি কোনোদিন। অন্যায়কে স্বীকার করেছে। দুর্নীতিকে দেখেছে। কিন্তু পাপ? সে তো সমাজের বানানো এক মানুষের মনুষ্যত্ব হাপিশের যন্ত্র। যে যত দুর্বল সে পাপের চাপে মরে তত বেশি। ইলা বোঝাতে চেষ্টা করত, গুপ্তরোগ কোনো পাপের ফল না, অসাবধানতার ফল।
কিন্তু মোহের মোহ বড় শক্তিশালী, চাইলেও মানুষ ছাড়তে চায় না। হয় তো মানুষ স্বচ্ছতাকে ভয় পায়। তার সাজানো পর্দাঘেরা সংসারে এত রঙবেরঙের আলো, সব সরিয়ে সাদা আলোতে থাকতে কার ভালো লাগে? ইলার ভালো লাগে। সে তাই গল্প শুনেছে, প্রলেপ দিয়েছে, ওষুধ দিয়েছে। নিন্দা করেনি, দোষারোপ করেনি। একে তাকে দোষারোপ করে বেড়ানোটা মানুষের স্বভাবের দুর্বলতা, বাবা বলতেন। বুঝতে শিখলে সব স্পষ্ট।
কবিতা
========
এই একটাই ওয়েসিস সংসারে ছিল ইলার। বিভাস কোনোদিন তার কবিতা পড়ত না। ইলার জীবনের কক্ষপথে কবিতা ছিল ধূমকেতুর মত, বিভাসের কাছে। প্রথম প্রথম অপমান, ব্যঙ্গ, অনেক কিছু করেছে। যেদিন পাড়ার পুজোর পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছিল, প্রায় গায়ে হাত দিতে এসেছিল, সাহসে কুলায়নি। ইলা কিন্তু সরেও যায়নি, বাধাও দেয়নি। বিভাস পত্রিকাটা পুড়িয়ে ফেলেছিল। ইলা ক্লাবের সম্পাদককে পুজোর মণ্ডপে বলেছিল, তোমাদের দাদা চশমা না পরে সিগারেট ধরাতে গিয়ে ম্যাগাজিনটাই জ্বালিয়ে দিয়েছে। আরেকটা দিও তো।
সম্পাদক ইলা আর বিভাসের চোখের ভাষা বুঝেছিল। আরো চারটে পত্রিকা দিয়ে বলেছিল, দেখো দাদা যেন আবার ভুল করে পুড়িয়ে না ফেলে।
বিভাস বলেছিল, বেশ্যা। ইলা বলেছিল, ওটা পেশা। ওতে অপমানিত হই না। দেশভাগের পর তোমাদের ঠাকুরের দয়ায় অনেক মেয়েকে বম্বেতে নিয়ে গিয়ে তোমাদের ঠাকুর ওই পেশায় বাঁচিয়ে রেখেছে। যাবে নাকি? দেখবে?
ইলার কবিতা বেরিয়েছে ছোটোখাটো কিছু পত্রিকায়। তবে বেশিরভাগটাই কলমের কালির শরীর পেরিয়ে ছাপা অক্ষরে আসেনি। ইলার দু:খ ছিল, কিন্তু ক্ষোভ ছিল না। কবিতারা যে তার কাছে এসেছে, এ-ই না অনেক।
একবার কলকাতা বইমেলায় গিয়ে মনে হয়েছিল এই যে এত মানুষ, ভাগ্যিস তাকে চেনে না সবাই। তাকে সবাই চেনে ভাবতেই ইলার লজ্জা লেগেছিল। ইলার লজ্জাটা অভিমানের লজ্জা। সেটা স্পষ্ট করে সে নিজেও বুঝত না। কিন্তু সে লজ্জার অস্তিত্ব টের পেত। অভিমান থেকে লজ্জা জন্মায়, না লজ্জা থেকে অভিমান, বুঝলই না ইলা। তেমন দরদী কেউ পাশে এলোই না সারাজীবন, যে বোঝাবে তাকে। মানুষকি সবটা একা একা নিজেকে বুঝতে পারে? দরদ ছাড়া?
বর্তমান
======
গঙ্গারতি শুরু হবে। ইলা একটা ফাঁকা নৌকায় বসে। ঘরের কথা, বাবার কথা, সব মনে পড়ছে। সে যেন অনন্তকাল এই নৌকায় বসে আছে। অল্প অল্প দুলছে। কোথাও যেন তার যাওয়ার নেই। ইলার কোনো জিজ্ঞাসা নেই, অভিমান নেই, ক্ষোভ নেই, রাগ নেই। জীবন বলতে যা বোঝায় সবটা সে হাতের মধ্যেই নেড়েঘেঁটে দেখেছে। বাড়তি সুখ, বাড়তি দু:খ, বাড়তি কিছুকেই আমল দেয়নি।
ইলা বড় নাতিটাকে খুঁজছে। বড় হেলায় কাটালো ছেলেটা জীবনটা। একবার জিজ্ঞাসা করবে তাকে, কিসের অভাব ছিল তার? কোনোদিন মুখ খোলেনি সে কারোর কাছে। ইলাকেও সহ্য করতে পারত না। ওর মধ্যে একটা ঠাকুর্দার স্বভাব ছিল। বাড়ির মেয়েদের নাকি স্বভাব খারাপ করে দিচ্ছে ঠাকুমা… এই নিয়ে অনেকবার অশান্তিও করেছে। কিন্তু কেন ভয় পেত ইলাকে সে? এই প্রশ্নটাই ইলার করার ইচ্ছা নাতিকে। দরদ মিশিয়ে। যদি বলতে পারে, যদি উত্তর দেয়।