ট্রেনটা যখন খড়গপুর ছাড়িয়ে হাওড়ার দিকে চলতে শুরু করে, তখন চোখে প্রাণে একটা স্বস্তি জাগে।
হাওড়ায় নেমে কানের উপর যখন কোলাহলের বন্যা নামে। তখনও এক গভীর স্বস্তি জাগে।
অনেক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে ভাষাটার, সমষ্টিগত দিক থেকে দেখলে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে কাজের জগত, শিল্প-সিনেমা-সাহিত্য সর্বত্র দুর্বল হচ্ছে মাটি, জানি। সাক্ষী থাকছি। এ সমষ্টিগত চেতনায়।
কিন্তু ব্যষ্টি চেতনায়, যেখানে আমি একা, সেখানে তো সেই হাওড়া সালকিয়ার সরস্বতী প্রাইমারি স্কুলের বেঞ্চ, বাংলা বই হাতে দিদিমণি, স্যার। কিশলয়ের পাতা। লাইনটানা সাদা সাদা কাগজে ক খ গ ঘ।
তারপর গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত বসন্ত, সুখদু:খ, সুদিন, দুর্দিন - রবীন্দ্রনাথ। স্বস্তি। শান্তি। আরাম। সবই আমি একা দাঁড়ালে। একা হলে। সমষ্টিতে ক্ষয়ে যাচ্ছি জানি। অল্প অল্প হারিয়ে যাচ্ছি দেখছিই তো। কিন্তু একা দাঁড়ালে সেই তো সেই কীর্তনের আখর, বাউলের সুর, কথামৃতের আশ্বাস, চৈতন্যচরিতামৃতের মাধুর্য। সব হারিয়ে যাচ্ছে জানি। সাক্ষী থাকছিই তো।
একা মানুষের আয়ুষ্কাল সীমিত। ধরাবাঁধা মাটিতে পা রাখার সময়। একা মানুষের অল্প কিছু সাধস্বপ্ন। সেখানে আমি আমিই। আমার শৈশবে জাগা ভাষার আশ্রয়ে।
একটা অর্ধসত্য শুনি, ভাষা নাকি চাপিয়ে দেওয়া যায়। আর সব চাপানো যায়, ভাষা চাপাতে গেলে নিজের ভাষার মাধুর্য-ঐশ্বর্যকে আগে শূন্যের কাছাকাছি আনতে হয়। যারা তার নাগাল পায় না, তাদেরই মনে চাপিয়ে দিচ্ছে। নইলে তিনশোতেত্রিশ কোটি ভাষার মধ্যে থেকেও নিজের ভাষার খুঁটি হারিয়ে ফেলে না মানুষ। যদি না হারাতে চায়, নিজেই।
আমরা যে প্রজন্মের, সে প্রজন্ম একদিন শেষ হয়ে যাবে। আগামী প্রজন্ম হয় তো অন্যরকম হবে। অন্য ভাষায় ভাববে, ভালোবাসবে, কাঁদবে। তাদের সঙ্গে হয় তো আমার মিল হবে না, ভাষায়। বহিরঙ্গে। কিন্তু গভীরে তাকে চিনব কি করে সে বাঙালি? যদি আবার হাজার বছর পর ফিরে আসি? চিহ্ন থাকবে কি কিছু?
এ ভয়ও আমার ব্যষ্টি সত্তার। সমষ্টি তো হারিয়ে যায় না। বদলে গিয়ে অন্যভাবে থাকে। এই তো ভবিতব্য।