Skip to main content

একটু পর বৃষ্টি নামবে। মানে বোঝো? এই যে চারদিক অন্ধকার করে এসেছে, এর মানে বোঝো? 

     এর কোনো মানে নেই। সুরমার একা ঘরে, একা মেঘ রোদ বাতাসের আনাগোনা। সুরমার ভালোবাসা মানচিত্র বদলিয়েছে। অবস্থান, ভিন রাজ্যে। সুরমা ভালোবাসাকে নাম দিয়েছে, এক্কা দোক্কা। ছক কাটে। চাড়া ছুঁড়ে দেয়। তারপর খেলা… দাগে পা যেন না লাগে…। দাগ মানে অভিমান। বোবা অভিমান। বর্ষার মেঘ মানে অভিমান। 
সুরমা সজলের ছবিটা বার করে খাটে রাখল। গীতবিতান চাপা দিলো। হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে না? 

     দুপুরের খাওয়া শেষ। এঁটো তোলা হয়নি। ইচ্ছা করছে না। কিচ্ছু ইচ্ছা নিরীহ। ওরা বাঁচুক। নইলে পৃথিবীটা ন্যাড়া মাঠ হয়ে পড়ে থাকবে। 

     বেল বাজল। আবীর। 

     সুরমা একটা নার্সিংহোমে কাজ করে। যা আয়, ওতেই চলে যায়। বাবা মায়ের এক মেয়ে। বাবা মা নেই। বাড়িটা আছে। সজল স্কুলে পড়ত, কলেজেও একসঙ্গে। ভালোবাসা ছিল। প্রতিশ্রুতি ছিল। যেমন থাকে। ভেঙে গেল। যেমন ভাঙে। সজল বিয়ে করে এখন পুণেতে। 

     আবীর? 

     এই তো এলো ছেলেটা। বসুক। বলছি। সুরমার বয়েস? থাক না। বয়েস বললেই সমাজ ঢুকবে। হিসাব ঢুকবে। ছক ঢুকবে। 

     খেয়ে এসেছিস? 

     হ্যাঁ। তোমার খাওয়া তো শেষ… এঁটো তোলোনি আজও…. আমি তুলে দিচ্ছি..

     সুরমা বকল। কপট রাগ। আবীর তাকালো না। পরিষ্কার করল সব। সুরমা ন্যাতা কাড়তে গেল। থালা নিতে গেল। বাটি নিতে গেল। জোর করতে গেল। পারল না। কারণ? আবীরের গা ঘামা গন্ধ। অবশ করে দেয়। লুকোতে হয়। তার তো কাউকে দরকার নেই। বয়েস হয়েছে। সমাজ শাসন করেছে। 

     বয়েস? বলব না। সে তো নিজে থেকেই ঢুকে পড়ে। এই পড়ল না, দেখুন, পড়ল তো হুমড়ি খেয়ে এসে! অথচ দেখুন গল্পে একটা ফাঁকা বাড়ি আর দুজন মানুষ। সমাজ? বড় অদৃশ্য। বড় আপাত নিরীহ তার চলন। সে আসে। বসে। সংক্রামিত করে। লীন হয়। 

     আবীর সজলের ছবিটা হাতে নিলো। গীতবিতান সরিয়ে। বলল, ছবিটা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে না? 

     নতুন কি পোস্ট দিয়েছে রে?

     জানতাম। হাজার বলি, ফেসবুকটা অন্তত খোলো। 

     বেড়াতে গেছে নতুন কোথাও? ছেলেটার ছবি দিয়েছে? আর ওর বউ? ইনগ্রাম না কিসে আছে যেন… শাড়ির ছবি দেয়…

     সব বলছি… ইনস্টাগ্রাম ওটা। হ্যাঁ অনেক খবর আছে। এসো দেখাচ্ছি। 

     এ ডাক বিষণ্ণ ডাক। এ ডাক খাদের ডাক। আবীর হাতে মোবাইল তুলে দেবে। ক্রমে তাকে কাছে নেবে। একটা একটা আবরণ সরিয়ে তাকে আদর করবে। সুরমা মোবাইলে স্ক্রিনে আটকে থাকবে। সজলের প্রোফাইলে। চোখে কখনও জল, কখনও ঈর্ষা, কখনও ক্ষোভ, কখনও বিষণ্ণতা। আবীর দেখবে না। সে তার নগ্ন শরীরের মধ্যে ডুবছে নিজের নগ্নতা নিয়ে। ভালোবাসাহীন নগ্নতা কি নগ্ন! আবদারের আদর কি তীব্র, কি শূন্য! 

     সুরমার শরীর সুরমার কাছে আবদার করে। আবীরের ঘামের। আবীরের আদরের। আবীরের দেওয়া পৌরুষজাত সুখের। সুরমা না বলতে পারে না। তার দুর্বল "না" প্রজাপতির ক্ষীণ ডানার মত লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। আবীর মাড়িয়ে এগিয়ে আসে। আবীরের আবদারের কাছে নিজের শরীরের আবদার সঙ্গী পায়। মাতে। ঘোর তৈরি করে। তারপর সব শূন্য করে ফিরে যায় আবীর। সুরমা মৃত প্রজাপতির ডানাটা আবার খোঁজে। 

 

======== =======

     সজল সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছিল পুরী। মানে ও এখানে এসেছিল। কবে? যখন তার নিজের করোনা। হিসাব করেছে সারা সন্ধ্যে সুরমা। বার বার হিসাব করেছে। হিসাবের সংখ্যায় সজলের হাসি লেগেছে। সজলের গলার আওয়াজ মিশেছে। সজল… সজল…. উফ… আমায় আঁকড়ে ধরো… আমায় ঘিরে নাও… আমায় বাড়িতে ডাকো…. ঝি ছাড়িয়ে দাও… কাজের লোক থাক… আমি তো সব পারি….

     বুক উথলে এলো ঘেন্না। নিজের উপর ঘেন্না। ছি ছি… এত নীচে কেন নামছে… এত এত শূন্য সে সজলকে ছাড়া! 

     আবীর বলেছে সামনের উইকেণ্ডে দীঘা যাবে। কতবার গেছে। আবীর কি না করে? আজ যাওয়ার আগে চপ দিয়ে গেল। আজ বৃষ্টি না! যাওয়ার আগে বলে গেল শেভ কোরো… রোজ ভুলে যাও…. আবীর আবদার জানায়। সে আবদারে সাড়া দেয় পোষ্য সুখ শরীর জুড়ে। 

     রাত একটা। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলবে? ক্লান্ত শরীর। খাটে আবীরের গায়ের গন্ধ। আবদার কখনও হয়, ভালোবাসা? 

     জানলার পাশে বসল সুরমা। ছাঁট আসছে বৃষ্টির। কপাল ভিজে যাচ্ছে। এখন কেউ আসবে না। এখন আবদার নেই। ভালোবাসা নেই। সবাই ঘুমাচ্ছে। এখন আসে মৃত্যু চিন্তা। একা একা ঘরময় ঘোরে, আর বলে, সব ঝুট হ্যায়… সব ঝুট হ্যায়…. একটা দড়ি আর একটা আস্ত সিলিংফ্যান তাকে বলে, দূরে যা মেয়ে.. দূরে যা…. সুরমা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দূরত্ব মাপে। ভাবে কমছে, না বাড়ছে?

 

======== =======

 

     দীঘার সমুদ্র ভালো না। এর চাইতে পুরী ভালো। 

     সুরমা আবীরের কাঁধে মাথা রেখে বসে। সামনে সমুদ্র। 

     আবীর বলল, একটা কথা আছে। 

     সুরমা চোখটা বন্ধ করেই বলল, বল। 

     সে তোমার ফোন নাম্বার চেয়েছে।

     সুরমার কানের উপর থেকে সমুদ্রের শব্দ, বাতাসের শব্দ, মানুষের চীৎকার, হাঁকডাক সব সরে গেল। আবীরের কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে বলল, মানে? 

     মানে তো স্পষ্ট। তবু জিজ্ঞাসা করতে হয়। নইলে নিজেকে আদেখলা লাগে। কাঙাল লাগে। 

     আমি ফ্রেণ্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে তোমার ছবি দেখে মেসেঞ্জারে জিজ্ঞাসা করল, আমি কিভাবে চিনি তোমাকে… এইসব….

     সুরমা আসলে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। আবীরকে অসহ্য লাগছে। আবীর যেন অনুপ্রবেশকারী। কি নির্লজ্জ, কি নির্মম নিষ্ঠুর সে! এতটুকু নির্জনতা নেই তার নিজের জন্যে? সজলকে সে বাইরে কবে চেয়েছে? বাইরে আগলিয়ে আছে সমাজ, শরীর আগলিয়ে আছে বয়েস! ছি ছি! সজলকে সে যেখানে পেয়েছে সেখানে কাউকে হারানো যায় না… আবীর বোঝে এসব? বোঝে?

     সুরমা চুপ করে থাকল। আবীর তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে… ফোন নাম্বার দেব? দেব? আবীরের চোখে ঈর্ষা, কৌতুক, নিষ্ঠুরতা। সুরমা তাকালো না বেশিক্ষণ। চুপ করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকল। সমুদ্র মানে জলের স্তূপ। ঢেউ কই? 

     আবীর আবার জিজ্ঞাসা করছে, দিই ফোন নাম্বার? দিই?

     সুরমা হঠাৎ চোয়াল দুটো শক্ত করে বলল, আমি যদি আর শেভ না করি?