Skip to main content
 
কঠোর লকডাউন নিয়ে প্রচুর ধোঁয়াশা। লকডাউনে কি সত্যিই আর আস্থা আছে? বলা শক্ত। মার্চ থেকে জুনের শেষ অবধি লকডাউন শব্দটার উপর থেকে আস্থা কমতে শুরু করল। আক্রান্তের সংখ্যা যত বাড়ল আতঙ্ক তত কমল। কারণ জীবিকাকে স্তব্ধ রেখে জীবন বাঁচিয়ে রাখা যায় কি করে - এ সমীকরণ কোনো প্রজ্ঞাবান মানুষই করে উঠতে পারলেন না। অগত্যা বাঁধ ভাঙতে শুরু করল।
       এখন আতঙ্ক শুধু টিভির সংবাদ পাঠকপাঠিকাদের গলায় আর খবরের কাগজের ভাষায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা মরিয়া ভাব বেঁচে থাকার। হঠাৎ করে বলা হল সবাই কাজে এসো। এদিকে ট্রেন নেই, এতগুলো মানুষ হাজিরা দিতে যে যার মত সম্বল জুটিয়ে ছুটল। আমি হালিশহরে থাকি, কিভাবে যে এখান থেকে মানুষ কলকাতায় কাজে যাচ্ছেন জানলে হতবাক হতে হয়। কেউ স্কুটিতে, কেউ বাইকে, বাসে, গাড়ি ভাড়া করে, কেউ অটো, টোটো ইত্যাদি ভেঙে ভেঙে বারাকপুর অবধি গিয়ে তারপরে বাসে। করুণ অবস্থা। চাকরি বাঁচাতে হবে তো!
       এখন এই কয়েক মাসে অনেকের পরিবারেরই জমা সম্বলটুকু তলানিতে এসে ঠেকেছে। তাকে যদি বলো, তুমি ঘর থেকে বেরিয়ো না, সে কি যুক্তিতে শুনবে? নাকি শুভবুদ্ধিতে ভাবার মত আর্থিকসঙ্গতি তার আছে? শুভবুদ্ধি, ঠাণ্ডামাথায় ভাবা, কে কে মাস্ক পরে বেরোচ্ছে, কে বেরোচ্ছে না ইত্যাদি কৌতুহলী সমীক্ষা চালাতে যে আর্থিক নিরাপত্তা থাকাটা বাঞ্ছনীয় সেটা অনেকেরই নেই এখন। তার সাথে পরিবারে আনুষাঙ্গিক অনেক খরচ বেড়েছে। যার মধ্যে অনলাইন পড়ানোর নেটের খরচও অনেকের কাছেই যৎসামান্য নয়।
       অগত্যা পরিস্থিতিটা জটিল হলেও সমাধানের পথ একমাত্রিক নয়। মাস্কের ব্যবহার, স্যানিটাইজারের ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে সচেতনতা বাড়ুক, জরিমানার ব্যবস্থা করা হোক। সেগুলো খুব ঠিকঠাক পদক্ষেপ। কিন্তু কঠোর লকডাউনের ব্যবস্থা কতটা সম্ভব বাস্তবে ভেবে দেখার। কন্টেনমেণ্ট জোনের সংখ্যা আরো বাড়বে যতদিন যাবে। বাড়ছেও। তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অবশ্যই জনঘনত্ব, অর্থনৈতিক অবস্থান, মানসিক গঠন ইত্যাদি আছেই। তবু এও সত্যি যে এই ভারতের ইতিহাসেই বহু মহামারীর উদাহরণ আছে। কলেরা, প্লেগ, বসন্ত ইত্যাদির কথা কয়েক দশক পিছিয়ে গেলেই আছে। ভারতের ইতিহাসে মহামারী কোনো নতুন অধ্যায় নয়, তার সাথে মোকাবিলা সে আগেও করে টিকে গেছে, এবারেও তার অন্যথা হবে না। তবে আজকের যুগে আজকের মত করে তার মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতিটাও নেওয়া উচিৎ। সেটা আতঙ্কে নয়, ধৈর্য আর বিজ্ঞানপুষ্ট যুক্তির সাহায্যেই।
       ভাবনাটা হচ্ছে আতঙ্ক আগের মত নেই আর। তাই আগের মত গায়ের জোরে আটকানো এখন খুব কঠিন। এক, জীবিকা রক্ষার মরিয়া চেষ্টা, দুই, সংখ্যার আধিক্যে আতঙ্কটার মাত্রা কম। আমরা কখন ভয় পাই? অমুকের হয়েছে শুনলে, অমুক মারা গেছে শুনলে। কিন্তু এতজন আক্রান্ত, এতজন মৃত - এ তথ্যে কোনো অনুভূতি হয় না। ত্রাস শুরুতে মানুষকে সঙ্কুচিত করলেও, পরে সেই ত্রাসের মাত্রাতিরিক্ত অবস্থায় বেপরোয়াভাব উদ্রেক করে। এ মানুষের স্বভাব, একে নিয়ে তর্কে নেমে লাভ নেই। নইলে এত সিগারেটের দোকান রমরমিয়ে চলত না। এত ভয়াবহ বিজ্ঞাপনের বহর সত্ত্বেও। মানুষ তার প্যাশনের দাস। যে মানুষটা মরিয়া হয়ে রাস্তায় বেরোচ্ছে, সে তার জীবিকা রক্ষার জীবনের প্রাথমিক যে প্যাশন, সে হল তার বেঁচে থাকার তাগিদ, আর যে তাদের গালিগালাজ করে পাড়া কাঁপাচ্ছে, ফেসবুক কাঁপাচ্ছে সেও আরেক প্যাশনের দাস, ভয়-আতঙ্ক, যার মূলেও সেই এক - বেঁচে থাকার তাগিদ। দুজনেরই বেঁচে থাকার তাগিদ, শুধু ভাবনাটার দিক আলাদা, আর্থিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে।
       সমস্যাটা আসলেই খুব জটিল। কিছুটা সাম্যতা রাখার চেষ্টা আর বাকিটা আমাদের ভাগ্য - এর সমীকরণেই আগামীদিন।