Skip to main content

গভীর অন্ধকার। গুহার মধ্যে। সুখ আছে। স্বপ্ন আছে। কৌতুহল আছে। প্রশ্ন আছে। অনেক আকস্মিকতায় অনেক বিস্ময় আছে।

একদিন কী দৈবযোগে আলো এসে পড়ল গুহায়। যে ছিদ্র দিয়ে আলো এলো, সে ছিদ্র পথ হতে পারে না বেরোবার। কারণ কী কৌশলে সে ছিদ্রের মুখ ঢাকা। স্বচ্ছ আস্তরণে। আলো আসতে পারে। আমি বেরোতে পারি না।

সে আলোয় গুহার যতটা দেখা যায়, তাকালাম। বিষাক্ত সাপ, বিষাক্ত পোকামাকড়, বিষাক্ত তরুলতায় ঘেরা চারদিকে। আরো আছে বিপদ। খাদ। আগুন। তার মধ্যেই কয়েকটা সুগন্ধী ফুলগাছ। শীতল নদী। মনোহর সরোবর।

আলো যত বাড়ে, আমার বিপদের বোধ তত বাড়ে। স্বপ্ন তত শুকায়। আশা তত তীব্র হয় - বাঁচার। এ সবের অর্থ খোঁজার। শান্তি নেই। অশান্তিও নেই। আছে তীব্র দাবদাহের দহন জ্বালা। কিন্তু শুধুই কি জ্বালা? না। সঙ্গে এই যে আলোতে জেগে জানার সুখ। বিপদকে বিপদ বলে জানার আনন্দ। নিশ্চিতকে নিশ্চিত বলে জানার, অনিশ্চিতকে অনিশ্চিত বলে জানার আনন্দ। আবিষ্কারের আনন্দ। সত্যকে আবিস্কারের আনন্দ তো আছেই, সে যতই ভয়াবহ হোক, দুঃসহ হোক।

কিন্তু এবার? কতদিন নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারব? একি ভীষণ ভয়াল চারদিক। উপায়?

কানে কত ফিসফিস। কেউ বলল, এ জগত এমনই। দুঃখ, বিপদসঙ্কুল। কেউ বলল, আসলে সবটাই ভ্রম - এ আলো, এ গুহা, তুমি…সব ভ্রম। মনের কল্পনা। মিথ্যা। চারদিকে তাকিয়ে দেখ, মানুষ আত্মকরুণায় কাতর। কেউ বলছে, আমি কী ভীষণ একা! কেউ বলছে ভাগ্য আমায় নিয়ে কী ছিনিমিনি খেলছে! আবার কেউ অন্ধকারে আরো বেশি সেঁধিয়ে গিয়ে, কয়েকটা সুগন্ধী ফুলের নির্যাস গায়ে মেখে বলছে, দুঃখ কোথায়? এতো আমার সুখের উপবন! কেউ মহা হুঙ্কারে বলছে, সব চিবিয়ে খাব, তছনছ করে দেব, আমায় চেনো না, আমি অন্ধকারের রাজা!

আমি সব শুনতে শুনতে বারবার সেই দৈবে জাগা আলোর দিকে তাকাচ্ছি। কী উদাসীন আলো। কী নিষ্ঠুর! কী নিস্পৃহ! এ গুহার মধ্যে এত আস্ফালনে, এত হাহাকারে কোনো আগ্রহ নেই তার।

কেউ কেউ নানা মূর্তি সাজিয়ে, কেউ কেউ নানা অদ্ভুত স্থাপত্য নির্মাণ করে, নানা অদ্ভুত পোশাক পরে, অদ্ভুত সব গল্প বলে, ছোটো-ছোটো দল করে বসে আছে। বলছে, সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন। এ গুহা ভেঙে নেমে আসবে আলো। আসবে আলোকময় উদ্ধারকর্তা।

সেই শুনে কেউ কেউ প্রশ্ন করছে, কবে? এ গল্প তো আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দাও শুনে আসছে….কিন্তু কবে?

প্রশ্নকর্তাকে অনেকে ধরে অন্ধকারে নিয়ে চলে যাচ্ছে। প্রশ্ন থেমে গেলেই আবার গল্পের সুর চড়া হচ্ছে।

আলোর দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছি। নিস্পৃহ, নিষ্ঠুর আলোর দিকে। সামনে চলছে সংসারে গুহাহিত লীলাখেলা। জন্মমৃত্যু, সুখ-দুঃখের আবর্তন।

দেখছি বিষাক্ত সাপের ডিম ফুটে জন্মাচ্ছে বাচ্চারা। দেখছি ইঁদুর তার বাচ্চাগুলোকে নিয়ে অদূরেই সংসার পেতেছে। প্রতিদিন ভাবছি একদিন হয় তো সব নিরীহ দুর্বল প্রাণ নিঃশেষ হয়ে যাবে প্রবলের হাতে। শুধু প্রবলেরই হবে জয়। কিন্তু নয়। এত শিকারের পরেও শিকার আর শিকারীর সমীকরণ টিকেই থাকছে। শিকারী নিজেও শিকার হচ্ছে। ইঁদুরের গর্তে শুধু ভয় নেই। আছে আনন্দ। জীবননির্ভরতা। সাপের গর্তে শুধু নিষ্ঠুরতা নেই। আছে স্নেহের স্নিগ্ধ প্রলেপ। আছে জীবনময়তা।

আলোয় বসে বসে দেখছি, আলো-অন্ধকারে মিশে চলেছে জীবন। প্রাণসাগরে জাগা ছোটো বুদবুদের জীবনময়তা আর জীবননির্ভরতা। এর কী অর্থ আমি জানি না। “আমি” সে আলো নই, যে আলোতে সব রহস্যের চাবিকাঠি আছে। ‘আমি’ এক সময়ের বুদবুদ। এক বিন্দু বোধের প্রতিচ্ছবি। যার নিজের মধ্যে নিজের কোনো অর্থ নেই। তার অর্থ নেই। সার্থক হওয়ার সাধনা আছে, জীবনময়তায়। জীবননির্ভরতায়। নিষ্ঠুরতায় নয়। ব্যথাকে বরণ করে বোধের আনন্দসজ্জায়।