শোনো, কত মানুষের অভিযোগের উত্তর দেবে? কত? তুমি শেষ হয়ে যাবে কিন্তু মানুষের অভিযোগ শেষ হবে না। দেখো না মৃত মানুষদের নিয়েও মানুষের কত অভিযোগ। যার নাভি ভেসে গেছে কত শতাব্দী আগে জলে, যে মানুষ মাটিতে মিশতে মিশতে শত শতাব্দী পার হয়ে গেল, তাকে নিয়েও মানুষের অভিযোগ। অভিযোগ শেষ হয় না। সে যেন রক্তবীজ।
পার পাবে না, তাই বলছিলাম পার পাবে না কোনোদিন। অভিযোগের পর অভিযোগ আসতেই থাকবে। মৃত্যুর পরও আসবে, নিশ্চিত জেনে রেখো।
তবে উপায়? ক্রমশ সয়ে যাবে। দেখে নাও সত্যিই তোমার কিছু করার আছে কিনা। যদি থাকে করে ফেলো, যদি না থাকে চুপ করে থাকো। তোমার অনুভব, তোমার পরিস্থিতি, তোমার লিমিটেশন, তোমার দুর্বলতা, তোমার সবলতা - সবই তোমার, একান্তভাবে তোমার। কেউ বুঝবে তা হয় না। সেটাই স্বাভাবিক। ভুল বুঝবে - এটা হয়, বারবার হয়। সেটাও স্বাভাবিক। পুরো জগতটাই এই ভুল বোঝাবুঝিতে চলছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখো, ঠিক ঠিক বোঝা কি সম্ভব? না সম্ভব না। নিজেকেই যেখানে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, সেখানে অন্যকে স্পষ্ট বুঝি দাবী করা নিতান্তই মূর্খামি। তাই এত ধুলো ঝড়। এত বালি চোখ খুললেই। আমার তোমাকে নিয়ে যদি কিছু বোঝা স্পষ্ট থাকে সে আমার অনুমানের ভাগ্য, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু অনুমান যে সব বারেই ঠিক হবে তাই কি হয়? হয় না। এ কথা তাই নিজেকে বারবার বলি, আমার বোঝার ক্ষমতা নেই, অনুমান করার ক্ষমতা আছে। সে অনুমান হয় তো কখনও কখনও সত্যের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছায়, সে নিতান্তই ভাগ্য - এ যেন মনে রাখি। তবে ভুল হলে ক্ষোভ হয় না, আর অনুমান সত্যি হলে "তোমায় বুঝেছি" বলে তোমার উপর দাবী জানাতে যাই না।
জীবনটা এইভাবেই কাটবে। আমি কত মানুষকে দেখেছি সারাটা জীবন কাটিয়ে গেল শুধু তাকে কেউ বুঝবে এই আশায়। কি এক অলীক কল্পনা। কি অবাস্তব অযৌক্তিক আশা। তাই কি হয়? ওসব মরীচিকা। এ অভিমান যত তাড়াতাড়ি ছেড়ে কুয়াশার ঘনঘটা থেকে বেরিয়ে দিনের আলোয় এসে দাঁড়ানো যায় ততই মঙ্গল।
তবে জীবনে চাই কি? সুখ। কদাপি না। চাই একটাই জিনিস, জীবনে শেষদিন অবধি যেন মানসিক ভারসাম্য রাখতে পারি, ইংরাজি ভাষায় যেন স্যানিটি না হারাই। এই অনেক হবে। বাকি যত অভিযোগ মাথা পেতে নেব? বালাইষাট, মাথা পাততে যাব কেন? সব অভিযোগ আমার বিবেচনার ঘরে নেব। নিস্পৃহ, নিরাসক্ত থেকে। যদি দোষী হই তবে সুরাহা খুঁজব, যদি না হই তবে হাওয়ায় সে আপনি ভেসে যাবে। মনের মধ্যে অভিমানের তাওয়ায় সেঁকে সেঁকে তা নিয়ে ঘোঁট পাকিয়ে কি হবে? এইটুকু তো জীবন। তার মধ্যে সবাই চায় সব সময় আমি আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াই। বাপু অত সময় কি আছে রে? যদি তেমন কিছুতে মাঝে মধ্যে দাঁড়াতেই হয় সে না হয় দাঁড়াব। কিন্তু ভাই তোদের মোকদ্দমার শেষ নেই যে, তাই কোর্ট রুমের বাইরে যে এত বড় জগত আছে তা ভুলেই গেলি। তোদের ভুললে চলে, আমি বড় হ্যাংলা, আমার যে চলে না। আমি তাই "দাও না ছুটি ধরো ত্রুটি, নিই নে কানে, মন ভেসে যায় গানে গানে" সুরে বেড়িয়ে পড়লাম। এইতেই সুখ। আমি আশা রাখি না আমায় তোরা বুঝবি, তোরাও ভাই আশা রাখিস না আমি তোদের বুঝব। তবু কিছু কিছু সময় সুর যে মেলে এই আমাদের পরম ভাগ্য। সেটুকুই সার করি। বাকির হিসাব কে করে মরে? বলি আর কোনো কাজ নেই আমার?