Skip to main content

ভীষণ মেঘ করেছে দেখে ঝুনু ঝুড়ি বোনার সব কিছু নিয়ে বাড়ির সামনে যে টিলাটা আছে, সেই টিলার উপর যে শিব মন্দিরটা আছে, তার চাতালে গিয়ে বসল। এতটা উঠতে হাঁফ ধরে না যে তা নয়। ধরে। বুকটা হাপরের মত ওঠে পড়ে। উঠতে উঠতে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে, কতবার যে সারাদিন উঠত নামত! শরীরটা বদলে বদলে যাচ্ছে, মনটা না।

ঝুনু চাতালে এসে বসল। এখান থেকে গ্রামটা পটে আঁকা ছবির মত দেখায়। ঝুনু, ঝুড়ি বানানোর সব কাঠিগুলো একদিকে ফেলল। ব্যাগ থেকে দড়িগুলো বার করল। ব্যাগে দুটো রুটি আর গুড় আছে প্লাস্টিকে মোড়া। সেটা ব্যাগেই রেখে দিল, বার করলেই পিঁপড়ে ধরবে।

ঝুনু শিবমন্দিরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসল। ঝুনুর বয়েস এখন বাষট্টি। অনেক অনেক আগের কথা মনে পড়ল। কেমন করে বিয়ে হল। কেমন শ্বশুরবাড়িতে গায়ে আগুন দিয়ে দিয়েছিল। কি করে, কি করে বেঁচে গেল। বাবা মা মারা গেল। সে একা এ বাড়িতে ঝুড়ি বিক্রি করে, সেলাই করে এতগুলো দিন কাটিয়ে দিল। এখন সেলাই করতে চোখে লাগে। কিন্তু না দেখেও ঝুড়ি বুনে দিতে পারে। আগের মত অত নয়, তবে পারে। তার বানানো ঝুড়ির কদর আছে হাটে।

আকাশ কালো করে এসেছে। ঝুনু নিজের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। বাড়িটা ভালো লাগে। আবার লাগেও না। মনে হয় দূরে চলে গেলে অনেক ভালো হত। কতদূরে ভেবে উঠতে পারে না। আসলে ঝুনু সারাজীবন বেশি দূর বলতে শ্বশুরবাড়ির বাইরে কোথাও যায়নি তো।

ঝুনু ঝুড়ি নিয়ে বসল। একটা গান গাইতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু কথাগুলো মনে পড়ছে না। সুরটা মনে আছে। সুরটাই গুনগুন করে গাইতে গাইতে ঝুড়ির কাঠিগুলো একটা একটা করে হাঁটুতে চেপে বেঁকাতে লাগল।

হঠাৎ তার বরের মুখটা মনে পড়ে গেল। রোজ যখন তখন তার সঙ্গে জবরদস্তি করত। যেন সে বাজারের কেনা মাগী, চাইলেই যা তা করা যায়। ঝুনু গাছে উঠে থাকত। পুকুরে ডুবে থাকত। সারা গায়ে গোবর মেখে থাকত। সেই জন্যেই তো দিল পুড়িয়ে। "স্বামীর ভোগে না লাগলে এ শরীর নিয়ে কি হবে?, দে আগুন"। তার বর তার বন্ধুদেরও ডেকে এনেছিল। তাকে নষ্ট করবে বলে। পারেনি। শুধু পুড়িয়ে দিয়েছিল। মুখের অর্ধেকটা পোড়া ঝুনুর। একটা চোখ নষ্ট। আঙুলগুলোও পোড়া পোড়া। তাকে দেখলে বাচ্চারা খেয়ে নেয়, পড়তে বসে, ঠাণ্ডা জলে স্নান করে নেয়, তিতো ওষুধ খেয়ে নেয়।

ঝুনুর মাঝে মাঝে ভীষণ রাগ হয়। ভীষণ। কাঠিগুলো যেমন তার হাঁটুতে চেপে বেঁকে যাচ্ছে, মেয়ে মানুষ সংসারে এরকম বাধ্য না হলে নাকি সংসার অচল হয়ে যায়। ঝুনুর মা ঝুনুকে বোঝাতো। এক এক পুরুষের এক একরকম চাহিদা। কারোর ষাঁড়ের প্রকৃতি, কারোর খরগোশের, কারোর সিংহের। ঝুনু বোঝে না তার বরের কি প্রকৃতি। দানবের হবে।

বৃষ্টি নামল হুড়মুড় করে। কি বড় বড় ফোঁটা। পুরো গ্রামটা মুহূর্তে ঝাপসা হয়ে গেল। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। ঝুনু কাঠিগুলো পাশে রেখে মন্দিরের দরজার ভিতরে এসে বসল। বাইরে বৃষ্টির ছাঁট আসছে।

খুব জোরে বিদ্যুৎ চমকালো হঠাৎ। ঝলসে গেল চারদিক। ঝুনু কানে আঙুল দিল। তবু যেন মনে হল মাথা চিরে শব্দটা ঢুকে গেল।

ঝুনু চোখ খুলে তাকালো। তাকিয়ে অবাক। তার শরীরটা ঝলসে পড়ে আছে একদিকে কুণ্ডলী পাকিয়ে। ঝুড়ির কাঠিগুলো পুড়ে গেছে।

ঝুনু বাইরে এসে দাঁড়ালো। এত বৃষ্টি, এত বৃষ্টি, তার গায়ে লাগছে কই? ঝুনু উড়ে উড়ে গ্রামের উপর দিয়ে ঘুরে বেড়ালো। দুটো গ্রাম পরে তার শ্বশুরবাড়ি। গেলো। বসল কিছুক্ষণ। হাতের কাছে যা পেল ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলল।

আবার ফিরে এসে মন্দিরে বসল। দেখতে দেখতে আরো অনেকে এসে তার পাশে বসল। কাউকে চেনে না। কিন্তু তারা যেন তাকে চেনে। ঝুনু বলল, তোমাদের আমি চিনি? তারা একসঙ্গে সুর করে বলতে শুরু করল, কোনো পুরুষের চাহিদা ষাঁড়ের মত, কারোর খরগোশের, কারোর সিংহের। সব মেনে নিতে হয়, সব মেনে নিতে হয়।

ঝুনু কানে হাত চাপা দিল। সে উড়তে শুরু করল। জোরে, ভীষণ জোরে। তার পিছন পিছন সেই সব তারাও উড়তে শুরু করে বলতে লাগল, কাঠির মত বেঁকে যাও... নরম হও.. ঝুড়ি হও.. ঝুড়ির মধ্যে সংসার লালন করো….. সংসার টিকবে কি করে নইলে…..

ঝুনু এখনও উড়ছে। কানে হাত চাপা। এখনও হাতটা সরালেই আওয়াজ কানে আসছে। সেই আওয়াজ। ঝুনু এমন একটা জায়গা খুঁজছে যেখানে সব শান্ত হবে। সে জায়গাটা কই?

 

(If sex worker can say no, why can't a wife: Delhi High Court.)