সৌরভ ভট্টাচার্য
21 April 2018
এমন সময় প্রচণ্ড ঝড় উঠল। পুকুরের ধারের কৃষ্ণচূড়া গাছটা ঝড়ের হাওয়ায় দুলতে দুলতে পুকুরের উত্তাল জলকে ছুঁয়ে ফেলল। পুকুরের গায়ে শিহরণ জেগে গেল। এপারের ঢেউ লাগল ওপারে গিয়ে। চারদিকে বৃষ্টির সাজো সাজো রব। মাটির শুকনো ধুলো জলের সাথে মিশে সেজেছে নদী। কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে ইচ্ছামতো এঁকে বেঁকে। সন্ধ্যে আসার তো দেরিই ছিল। কালো মেঘের দাপটে সন্ধ্যাও এল সাততাড়াতাড়ি। শঙ্খধ্বনি চাপা পড়ে যাচ্ছে বাজের আওয়াজে। বিদ্যুতের এলোমেলো ঝলক এদিক সেদিক।
চম্পা সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে। চম্পা বিধবা। বাল্যবিধবা না। চম্পা যুবতী বিধবা। শহরের দোকানে মশলা ফেরী করে গ্রামে ফিরছিল। আর তিনটে গ্রাম পেরোলেই তার গ্রাম। চম্পার গায়ে একটা গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজ। ময়লা। জায়গায় জায়গায় কুঁচকে। সেলাই ফোঁড়ার দাগও আছে। চম্পা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে। বিদ্যুতের ঝলকে ওর কালো শুকিয়ে যাওয়া মুখটা ঝলসে ঝলসে উঠছে। ওর ঘরে রেখে আসা পাঁচ বছরের মেয়ে - বকুল। একাই আছে। আজ পাশের বাড়ির ওরাও নেই। গুরুবাড়ি গেছে - বগুলা। তার গ্রামের নাম পলাশী। মুর্শিদাবাদের না। নদীয়ার একটা গ্রাম। অখ্যাত গ্রাম।
চম্পার মুখে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। আরাম লাগছে। প্রচণ্ড খিদে পাচ্ছে। দুশ্চিন্তায় আরো খিদে বাড়ে। চারপাশে তাকিয়ে দেখল। আরো অনেকে দাঁড়িয়ে। দুধের ক্যান নিয়ে বলাই মেশো। ওদিকে ক্লাবের ছেলেগুলো গোল হয়ে বসে। চম্পা ওড়নাটা অজান্তেই ঠিক করে নিল। আরেকটু দূরে কয়েকটা ছেলে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে। এদিককার না মনে হচ্ছে। দূর থেকেই এসেছে। বৃষ্টিতে আটকে গেছে। তার মতই। পুকুরের ওপারে আমগাছগুলো দুলছে। আছাড়ি পাছাড়ি খাচ্ছে ঝড়ে। চম্পার ঠোঁটের আগায় মৃদু হাসির রেখা। মুখ দেখে মনে হচ্ছে মনের চাদর উড়েছে। যেন ফেলে আসা দিনের বর্ষা এই বৃষ্টির সাথে মিশেছে।
চম্পা তার ছোটোবেলার কথা ভাবছে। ক্লাস থ্রি অবধি পড়েছে। তার বাবা জুটমিলের দারোয়ান ছিল। তারা চার ভাই আর সে একাই বোন। সামনের এই আমবাগানটাতেই দাদাদের সাথে আসত।
বৃষ্টির দাপট আরো বাড়ল। সাথে ঝোড়ো হাওয়া। কুন্তল তাকে বিয়ে করবে বলেছে। কিন্তু বকুল? বকুলকে কি মেনে নেবে? কুন্তলের হাবভাব দেখে মনে হয় না ও মেনে নেবে। চম্পা কুন্তলের কথা ভাবল। কুন্তল তাদের কয়েকটা বাড়ি পরেই থাকে। মুদির দোকান। বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি হবে। তার থেকে বড় অনেক। কতই বা? নয় কি দশ? তার বৌ পালিয়েছে চার বছর হল।
জোরে একটা বাজ পড়ল। চম্পা চমকে উঠে ফোনটা অন করতে গেল। চার্জ শেষ। ভুলেই গিয়েছিল। চম্পা ঘড়ি দেখল - সাড়ে ছ'টা। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। সাইকেলটা বার করল। ঝিরঝির করে পড়ছে। পড়ুক। মেয়েটা একা। আজকাল ভয় করে ভীষণ। চারদিকে যা সব শুনছে। চম্পার সারা শরীর ভিজছে। জামাকাপড় ভিজিয়ে শরীরে মিশছে জল। কুন্তলের নগ্ন শরীরটা ভেসে এলো। কুন্তলের চুমু খাওয়া। কুন্তলের শরীরের ওম।
চম্পা কাঁপছে। খিদেতে, ঠাণ্ডায়, ভালোবাসার তৃষ্ণায়, দুশ্চিন্তায় তার খুব শীতশীত করছে। সাইকেলের গতি বাড়ালো। সামনে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ওই শুধু।
তার বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। জানলাটা দিয়ে লম্ফ'র আলো আসছে। বকুল আলো জ্বেলেছে। চম্পা সাইকেলের গতি কমালো। কুন্তলের দোকানে জেনারেটারের আলো। দোকানে কেউ নেই। আবছা আলোয় কুন্তলকে দেখা যাচ্ছে। কাগজ পড়ছে। চম্পা দাঁড়ালো। সাইকেল থেকে নামল। তার প্রচণ্ড শীতশীত করছে। জ্বর আসছে নাকি? জানলা দিয়ে বকুলকে দেখা যাচ্ছে। লম্ফ'র আলোর সামনে ফ্রক ছড়িয়ে বসে আছে। মেঝের দিকে তাকিয়ে। লুডো খেলছে বোধহয়। অথবা এমনি এমনিও বসে থাকতে পারে। তাও থাকে। কিসব ভাবে। ওর বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে।
বৃষ্টিটা বাড়ল। চম্পা সাইকেলটা নিয়ে হেঁটে হেঁটেই বাড়ির দিকে এগোলো। বাড়ির পাশেই একটা বড় বটগাছ। নির্মল এই গাছেই গলায় ফাঁস নিয়েছিল। চম্পা সাইকেল রেখে গাছটার দিকে এগোলো। গাছটার গুঁড়ি বেয়ে হুড়মুড় করে জল নামছে। বর্ষার জল। সেদিন মহালয়া ছিল। শাড়ি কেনা নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল। চম্পা বোকা ছিল। ভীষণ বোকা। চম্পা গাছটাকে বেড় দিল। হাউহাউ করে কান্না এলো তার। এরকম আসে। কেন আসে বোঝে না।
হঠাৎ একটা ছোঁয়ায় ফিরে তাকালো। বকুল দাঁড়িয়ে। মাথায় বিরাট একটা ছাতা। ওর বাবার ছাতা। চাষের সময় নিয়ে যেত। বকুল বলল, ঘরে এসো। ভিজে গেছ তো! বাবা সারাদিন খেলেছে আজ আমার সাথে। বলল, তুমি এত চিন্তা করো কেন?
চম্পা চমকে উঠে বলল, কই তোর বাবা?
বকুল বলল, চলে গেল তো, বলল তোর মা'কে ডেকে ঘরে নিয়ে আয়, আর বল যে আমি সব জানি, আমার কোনো আপত্তি নেই।
চম্পা চুপ করে গাছের নীচেই দাঁড়িয়ে রইল। একটা শুকনো ভিজে ফুলের মালা হঠাৎ করে গাছের উপর থেকে তার পায়ের কাছে পড়ল।