সৌরভ ভট্টাচার্য
1 April 2018
আমায় এখন ভূতে পেয়েছে। তাই খালি খালি ভূতের গপ্পো বলব। তবে আজ যেটা বলব, গপ্পো নয়। খাঁটি সত্য ঘটনা।
তখন আমি ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। মা, বাবা, ভাই বাড়িতে কেউ নেই। সব্বাই বড়মামার ওখানে গেছে সল্টলেকে। শনিবারে থেকে রবিবার ফিরবে। আমার রবিবার কিছু দরকারি টিউশান ছিল তাই আর গেলাম না। থেকেই গেলাম।
আমরা তখন কাঁচরাপাড়ায় থাকতাম। রেল কোয়াটার্সে। সাহেবদের বানানো দুম্বো দুম্বো কোয়াটার্স। কাঠের সিঁড়ি। একটা কোয়াটার্স এখানে তো আরেকটি ওই-ইই মুলুকে। চারদিকে বড় বড় গাছ। ঝোপঝাড়ের জঙ্গল তো আছেই। কেউ পরিষ্কার করে না।
সে যা হোক। আমাদের কোয়াটার্সটা দোতলা। নীচের তলায় যে কাকিমারা থাকতেন তারাও সেই উইক-এণ্ডে বেরিয়েছে। আমি পড়ে বাড়ি এলাম সন্ধ্যে সন্ধ্যে হবে। বাড়ি ফেরার সময়তেই টের পাচ্ছিলাম টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হুড়মুড় করে সাইকেল চালাতে লাগলাম। কারণ যেখানে পড়তে যাই সেখান থেকে আমাদের কলোনী মেলা দূর। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল, তার সাথে ঝড়। বাড়িতে বকুনি দেওয়ার কেউ নেই, তাই ভিজেই, গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরলাম। কলোনীতে ঢুকেই বুঝলাম কপালে দুঃখ আছে - কারেন্ট নেই। রেল কলোনীতে কারেন্ট যাওয়া মানে খুব দুঃখ। কর্মচারীরা পরেরদিন আলো না ফুটলে কাজেই আসবে না। একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। আমাদের কোয়াটার্সটায় একবার কিছু গোলযোগে পুরো কারেন্টময় হয়ে গেল। দেওয়ালে হাত দিলে ঝনঝন করছে, চৌবাচ্চার জলে হাত দিলে ঝটকা মারছে, সে এক হুলুস্থুলু কাণ্ড। আমি গেলাম রিপোর্ট করতে। আমায় বলল, "কারেন্ট মেরে মাটিতে ফেলে দিচ্ছে কি?" বললাম, "না ততটা নয়।" একজন কর্মচারী দাঁত খুঁচোতে খুঁচোতে বললেন, "তা এত রাত্রে এসেছ কেন বাপু (তখন সাড়ে সাতটাও বাজেনি)? কাল আমরা যাব।" এই হল গল্প।
তা বাড়িতে তালা খুলে দেখি ধুলোয় একাকার। কোনো জানলা বন্ধ করে যাইনি। পাশের আমগাছের বোল বিছানায়। বিছানার চাদর মাটিতে। আমি সেসব সেরকমই রেখে আগে স্নান সারলাম। শুনেছি বৃষ্টিতে ভেজার পর স্নান করলে ঠাণ্ডা লাগে না।
তারপর স্নানটান সেরে ঘরের পোশাক পরে, ঘরদোর গোছাতে লাগলাম। তখনও বাইরে তুমুল ঝড়, সাথে এলোপাথাড়ি বৃষ্টি। ঠাকুরঘরে প্রদীপ জ্বাললাম, ধূপ জ্বাললাম, মায়ের যা যা হুকুম ছিল আর কি।
তখন বাড়িতে চার্জার লাইট ছিল। তাই জ্বালিয়ে একবাটি মুড়ি চানাচুর মেখে খাটে গোছ হয়ে একটা গল্পের বই নিয়ে বসলাম। আটটা বেজে গেছে।
গল্পে ডুবে আছি। হঠাৎ মনে হল কাঠের সিঁড়িটা দিয়ে কেউ যেন উঠে আসছে। মনে হল মনের ভুল। বাইরে ঝড় হচ্ছে তারই কোনো আওয়াজ হবে। আমার এখনও মনে আছে, বইটা ছিল 'ডক্টর জেকেল অ্যাণ্ড মিস্টার হাইড'। আবার আওয়াজ। এবার উঠতেই হয়। চার্জার লাইটটা নিয়ে সিঁড়ির কাছটা দেখলাম। কিচ্ছু নেই। একটা টিকিটিকি দেওয়ালে শুধু।
ফিরে এসে আবার পড়তে শুরু করব, স্পষ্ট শুনলাম সিঁড়িতে থপ থপ করে পায়ের আওয়াজ। আমার গায়ে একটু কাঁটা দিয়ে উঠল ভয়ে। পেটের ভিতর কিরকম একটা চাপ চাপ অনুভূতি হল। উঠতে ইচ্ছা করছে কিন্তু পারছি না। শরীরটা ফ্রিজ হয়ে গেছে।
তবু একপ্রকার জোর করেই উঠলাম। চার্জারটা নিয়ে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ালাম। কিচ্ছু নেই। টিকটিকিটাও নেই। পা দুটো রীতিমত কাঁপছে মনে হচ্ছে আমার। বুকটা ধড়াস ধড়াস এমন করছে যে নিজের কানে বাইরে থেকেই শুনতে পাচ্ছি। কিছু চোখে পড়ল না। কিন্তু যেই ফিরতে যাব মনে হল সিঁড়িটা নীচের বারান্দায় যেখানে নেমেছে সেখানে যেন কেউ দাঁড়িয়ে। বড়সড় একটা ঢোক গিললাম। কি করব, চীৎকার করলে তো কেউ শুনতে পাবে না। ফোন বলে তখন কিছু আমাদের বাড়ি ছিল না যে কাউকে ডাকি।
যন্ত্রচালিতের মত এক পা, এক পা করে নীচে নামতে লাগলাম। চার্জারের আলোটা রেলিং-এর সোজা সোজা কাঠের পাতগুলোর বিরাট বিরাট ছায়া দেওয়ালে তৈরি করতে লাগল। আমার দৃষ্টি নীচের ছায়াটায় আটকে।
পাঁচ ছয় ধাপ নামতেই মনে হল, আমার পাশ দিয়ে হুড়মুড় করে আমায় ঠেলে কেউ উঠে গেল উপরে। আমি স্পষ্ট আওয়াজ শুনলাম। কেউ যে আমায় ধাক্কা মারল সেটাও স্পষ্ট অনুভব করলাম।
আমার মাথা ঘুরতে লাগল। ভয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া অ্যাদ্দিন বইতে পড়েছি। এই প্রথম অনুভব করলাম। আমি দেওয়ালে হেলান দিয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। কি করব?
হঠাৎ সাহস এসে গেল। ঠিক সাহস না বলাই ভালো। একটা মরিয়া হয়ে ওঠার মত কিছু হলাম। এক পা, এক পা করে আবার উপরে এলাম। আমার ঘরটায় পা টিপে টিপে ঢুকলাম। কেউ কোত্থাও নেই। বাইরে ঝড়টা একটু থেমেছে মনে হল। আমি খাটে এসে বসলাম। এখনও কাঁপছে শরীর। গলা শুকিয়ে কাঠ। ডাইনিং টেবিলে জলের বোতল। কিন্তু খাট থেকে আবার নামতে সাহস হচ্ছে না। কিন্তু উঠতে তো হবেই। জল না হয় না-ই খেলাম, টয়লেটে তো যেতেই হবে। পা টেনে টেনে এক প্রকার টয়লেটের দিকে এগোতে লাগলাম।
টয়লেয়েটের দরজায় হাত দিতে যাব, হঠাৎ মনে হল কেউ যেন একটা ধাক্কা মারল পিছন থেকে। মুখ থুবড়ে পড়লাম। প্রথমে ভাবলাম বৃষ্টির ছাঁট মাটিতে পড়েছে তাতেই কি? কিন্তু পিঠে... পিছনে তাকাতেই হাড় হিম হয়ে এলো। একটা বিদ্যুতের ঝলকানিতে স্পষ্ট মনে হল কেউ একটা আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ছ'ফুট লম্বা। পুরুষের শরীরের অবয়ব... অবিনাশকাকু?... রিকশা চালাতো। মাস দুই আগে আমাদের দুটো কোয়াটার্স পরের একটা আমগাছে গলায় দড়ি দিয়েছিল।
আমার আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান এলো, মনে হল বাইরে থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। বাবার এক বন্ধু। হাজরা কাকু। আমার যেন ওঠার শক্তিই নেই। কোনোরকমে উঠে হুড়মুড় করে নীচে নামলাম। হাজরাকাকু বললেন, "তোর বাবা ফোন করেছিল। এই ঝড়বৃষ্টিতে একা থাকার দরকার নেই। আমাদের বাড়ি চল।"