নৌকাটা বাঁধা ছিল ঘাটে। দীর্ঘদিন। কবে যে দড়িতে পচন ধরেছিল, কেউ জানতে পারেনি। জানান দিল ঝড়।
নৌকা এল মাঝনদীতে। কিন্তু তেমন তো কথা ছিল না। কথা তো ছিল আসবে ঝড়, লাগবে দোলা। থামবে নৌকা কয়েকটা ধাক্কার পর।
হল না। মাঝনদীতে ঝড়। মাঝি ভাবল, সে হয় তো পাবে এক্ষুণি ভীষণ ভয়। হয় তো নৌকা ছেড়ে এক্ষুনি দেবে ঝাঁপ জলে।
দিতও হয় তো। কিন্তু হঠাৎ তার চোখে পড়ল নৌকার ছাওনির নীচে বসে এক মুরগী, আর তার কোলের কাছে চারটে ছানা। তারা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ঝড়ের দিকে। মাঝি কি যাবে ছেড়ে?
মাঝি হয় তো যেত। মাঝি হয় তো ঝাঁপ দিত উত্তাল জলে। মাঝি হয় তো সাঁতরে এসে যেত এই পারে, কি ওই পারে। কিন্তু এখন? মুরগী তার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, পার করে দাও মাঝি, তারপর না হয় আমাকে কেটে সপরিবার খেও। কিন্তু আমার এ বাচ্চাগুলোকে করো ত্রাণ।
ঝড় উঠল হেইসান জোরে। নৌকা উঠল ঢেউয়ের বেগে শূন্যে। আছড়ে পড়ল জলে। বাচ্চাগুলো মায়ের ডানার নীচে গেল। মা বলল, মাঝি গো!
মাঝি তাকালো চারদিক। শুধু জল আর জল। বৃষ্টির দেওয়ালে ঝাপসা চারদিক। তীর নেই। ইষ্ট নেই। গুরু নেই। আছে দাঁড় আর হাল। তারাও অচল এই ঝড়ে। কি করে তবে সে?
মাঝি বলল মুরগীকে, ভয় নেই, আমি আছি। আমি থাকতে ডুববে নৌকা?! কক্ষনো না।
অমনি এলো আরেকটা ঢেউ। নৌকা উঠল আরো আরো উঁচুতে, শূন্যে। আবার খেল আছাড় জলে। মাঝি বলল, ভয় পাই না….. ভয় নেই…. কত দিবি আছাড়….. দে দে…. নৌকা ডুবলেও সাঁতার দিয়ে নিয়ে যাব ওদের ওপারে…. ওই ঝুড়ি চাপা দিয়ে…..
মাঝি নিজেকে দেখে নিজেই অবাক। এত সাহস তার! ক'দিন আগেও ঝড়ের মেঘ দেখে ইষ্টকে ডেকেছে প্রাণভরে। পাগলের মত শাঁখ বাজিয়েছে খাটের তলায় বসে। পিঁড়ি পেতেছে উঠানে। ঝড় থেমেছে। কিন্তু ঝড়ের থেকে বেশি আছড়েছে ভয়। নিজেকে দিয়েছে লজ্জা।
মুরগীগুলোকে ঝুড়ি তুলল মাঝি। তারপর দিল নিজের গায়ের জামাটা বেঁধে ঝুড়ির মাথায়। বলল, যদি ডোবে নৌকা, ভয় নেই, এই ঝুড়িই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে পারে। এ ঝুড়ি ডোবে না। এমনই হালকা। সব ফুটোফাটা মেরামত করা।
মুরগী জামার নীচ থেকে ডেকে বলল, আর তুমি?
মাঝি উত্তর দিল না। ছাওনির নীচ থেকে বেরিয়ে এসে ঝড়ের মধ্যে, বৃষ্টির মধ্যে হাল ধরে বসল কষে।
হঠাৎ খেলে গেল বিদ্যুৎ। সে আলোয় তার মনে হল যেন ইষ্ট দাঁড়িয়ে আকাশে রেখে মাথা, জলেতে রেখে পা।
বুকের মধ্যে শুনল মুরগীর ডাক। ইষ্ট নামের মত। আকুল ডাক। বিপদ থেকে বাঁচার ডাক না। ভয় থেকে বাঁচার ডাক। সে ডাক শুনতে শুনতে মাঝি বন্ধ করল চোখ, হালে রেখে হাত। বলল, যেদিকে ইচ্ছা নিয়ে যাও।
মাঝি যখন চোখ খুলল, তীরের রেখা দেখা যাচ্ছে মেঘ কাটা চাঁদের আলোয়। রাত হয়েছে।
মাঝি তীরে এসে মুক্ত করল মুরগীকে। সে তার বাচ্চাদের এগিয়ে দিয়ে বলল, চলো।
মাঝি বলল, যাও। আমি না, তুমিই বাঁচিয়েছ আমায় ঝড়ের হাত থেকে।