Skip to main content

যখন কাঁচরাপাড়া রেলকলোনীতে আসি তখন আমি ফাইভে পড়ি। হাওড়া সালকিয়ার ঘিঞ্জি ঘরবাড়ি ছেড়ে হঠাৎ করেই চারদিকে সবুজ আর সবুজ পরিবেশে এসে পড়লাম। কি আনন্দ, কি আনন্দ! পেয়ারাগাছ, আমগাছ, বটগাছ... আরো কত কত গাছ। আগে কই দেখেছি? রাতের বেলা ঘরের মধ্যে জোনাকি জ্বলে কই দেখেছি? ভোরে-সন্ধ্যেতে অমন চারদিকে পাখির কোলাহল.... আগে ভাবতে পেরেছি?

যা হোক বিহ্বল হয়ে পড়লাম। ফুর্তির চোটে পেয়ারা গাছে চড়া শিখলাম। নিজে নিজে। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরেই পেয়ারা গাছে চড়তাম। ক'দিন পর কলোনীর অনেকে বারণ করল, "কোয়াটার্সের ছেলেরা, ফোরম্যান, চার্জম্যান ইত্যাদির ছেলেরা গাছে চড়ে না দিদি / বৌদি... ওসব আউটহাউসের ছেলেমেয়েরা চড়ে, রেলকলোনীর ছেলেমেয়েরা শুধু পড়ে, আর ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়।"

বৈষ্ণব শাস্ত্রে একটা কথা আছে, গুরু কৃষ্ণ বৈষ্ণব তিনের কৃপা হল / একের কৃপা বিনা জীবন ছারেখারে গেল।

এই 'একের কৃপা' বলতে মনের কৃপা। মনের রাজী না হওয়া। আমার ভাগ্যে তাই হল। ওই নির্জনতা, ওই সবুজ, অত বড় আকাশ, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, শীত, বসন্তের ওরকম সাজ সাজ বেশ। বিশেষ করে বর্ষা। আমার ঘরের জানলার বাইরে এক বিশাল কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছ ছিল, তার ওপাশ থেকে যখন ঘন কালো মেঘ করে আসত…. সর্বনাশ হত। সর্বনাশের আশায় বসে থাকার ডাক নিয়ে এলো গীতবিতান। ব্যস, "আমা হইতে জাতিকূল নাহি গেল রাখা"।

আগের প্রসঙ্গে ফিরি। এই 'আউটহাউস' কেসটা কি? অনেকেই হয় তো জানেন না। আসলে কাঁচরাপাড়ায় রেলকলোনীর অনেকটা অংশই তৈরি হয় বৃটিশ আমলে। বড় বড় কোয়াটার্স। উঁচু উঁচু ছাদ। কাঠের সিঁড়ি। সেই কোয়াটার্সগুলো থেকে কিছুটা দূরে দূরে থাকত অত্যন্ত ছোটো ছোটো একটা ঘর যেখানে সাহেবদের কাজের লোকেরা থাকত। সাহেবরা চলে গেল। দেশী সাহেবের দেশী কাজের লোকের ব্যবস্থা তা-ই রয়ে গেল। আমার গাছে ওঠায় আপত্তি উঠল, আর মনের বাউণ্ডুলেপনায় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ওঠাও হল না। তবে কি সেখানে খেলাধূলা ছিল না? বিলক্ষণ ছিল। রেলকলোনীতে ক্রিকেট-ফুটবল দারুণ খেলা হত। কিন্তু আমার আবার ওসবে রুচি হত না। আমি আমার সাইকেলে টো টো করে এদিক ওদিক চরে বেড়াতাম। মনের মধ্যে বিদ্যাপতি, না ভানুসিংহ, না দেবেন্দ্রনাথের পোলাডা গরলামৃতের পেয়ালা হাতে…. সে বলা শক্ত।

তো সেই রেলকলোনীর বেশ কয়েকটা রাস্তা, মানে যাকে এভিনিউ বলে, রাতের বেলা বেশ ফাঁকা ফাঁকা থাকত। এমনিতেই রেলকলোনী ফাঁকা ফাঁকাই, কিন্তু কয়েকটা এভিনিউ বড্ড ফাঁকা থাকত। রাতের বেলা ঘুটঘুটে অন্ধকার। আলো বলতে হয় তারার আলো, নয় জোনাকির আলো আর নয় তো চাঁদের আলো।

যত বড় হলাম, রেলকলোনীর আরেকদিক কানে আসতে শুরু করল, চোখে পড়তে শুরু করল। যে সব রাস্তায় আলো থাকে না, ওখানে আসলে গোলমেলে কাজের আড্ডা জমে। যতবার রেল থেকে আলো লাগানো হয় ততবার ওরা ভেঙে দেয়। প্রত্যক্ষও করলাম তাই। আলো লাগানোর দু'দিনের মধ্যেই রাস্তা জুড়ে টিউবলাইটের ভাঙা সাদা টুকরো। বিস্ময়, আর বিস্ময়! বৃষ্টিভেজা মাঠে পড়ে আছে পরিত্যক্ত কণ্ডোম। মদের বোতল। বিস্ময়, এই তবে সেই! মনের নিষিদ্ধ ঘরে আমন্ত্রণ। সমাজে অনেক কিছু দেখবে, না দেখার ভান করে থাকবে। কেন? কারণ ভয়। অশান্তি কেন আনবে খুঁচিয়ে? তার চাইতে মনের মধ্যে নিষিদ্ধ ঘর বানাও। বুঝে লোক আনো সে ঘরে। যে সে রসের রসিক। যে চোখের ইশারা বোঝে। তাকেই আনো। অনুচ্চারিত নিষিদ্ধ সুখ কাকে বলে বোঝো! এই তো জীবন। আরেকদিক।

আরো জানতে পারলাম আউটহাউসের মেয়ে-বউদের সঙ্গে কোয়াটার্সের শিক্ষিত, ভদ্র রেলের কাকু, দাদা, জ্যেঠুদের অবৈধ সম্পর্কের গল্প। অবশ্যই সবার না। কারোর কারোর। মাঝে মাঝেই সেই নেই চাপান-উতোর। কানাকানি। ফিসফিসানি। অমুকের বউ ঘরে না থাকলে তমুক সাইকেল নিয়ে যায়, দেখেছ? দুপুরে, রাতে। সে অমুকের আউটহাউসে থাকে। শুনেছ? ওই পাগলী বউটাকে আবার ওরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল শুনেছেন… আর ও কি বলেছেন জানেন…. হো হো হো…. হি হি হি….. ও বলেছে তাড়াতাড়ি কর বাপু, আমার সকালে অনেক বাড়ি কাজে যাওয়ার আছে… হি হি হি….. হো হো হো….. ফিসফিস হাসির রোল।

সংসার কাজলের ঘর। চারদিকে কালি। সাবধান না হলেই কালিমাময় সব। সাবধান হও।

এ সব গল্প যখন শুনছি তখন আমার ব্রণ'র বয়েস। ক্রমে ব্রণ শুকিয়ে গেল। দাড়ি কাটতে কাটতে গাল শক্ত হল। এ সব গল্পও এলেবেলে জলভাত হল। শুধু বয়েস হয়ে যাওয়া ওই পাগলীকে দেখলে গলার কাছটা বুজে আসত মাঝে মাঝে। ওর রাতবিরেতে মাঠে শুয়ে বুক চাপড়ে কান্নায় হৃৎপিণ্ডটা পাগলের মত ছটফট করত। ক্রমে সেও সহ্য হল। বুঝলাম ধর্ষকের, ব্যভিচারীর চোখের রঙ কালোই হয়, কাঁধের নীচে দুটো হাত একই রকম হয়, কথা বলার সময় চোয়াল, জিভ আর দাঁতের চলাচলও একইরকম হয়। বাইরে থেকে সবাই একই।

আজ সেই রেলকলোনী প্রায় ধ্বংসস্তূপ। কোয়াটার্সের পর কোয়াটার্স ভাঙা। অত বড় কলোনী শুনশান। লোক নেই প্রায়। মাত্র কয়েকটা বাড়ি বাসযোগ্য। বাকি সব ভাঙা। কিন্তু যারা আছে, সেই সব ভাঙা কোয়াটার্সগুলোতে, যারা রেলের কর্মী নয়! তাদের অনায়াসে অসামাজিক, ক্রিমিনাল ইত্যাদি দাগিয়ে দেওয়া যায়। যারা হুক করে কারেন্ট টানে। সেই আলোতে টিভিতে শাহরুখের নাচ দেখে। দীপিকার জামার রঙ দেখে। সেখানে নীতির থার্মোমিটারে চড়া দাগে জ্বর ওঠে। কেউ আপত্তি করে না। আজ কেউ আলো ভাঙে না। আজ অনেক রাস্তা এমনিই অন্ধকার হয়ে পড়ে থাকে। রাস্তার দু'দিকের ঝোপ হেলে রাস্তার শরীরকে ঢেকে দেয়। কেউ বলে না এখানে সিসিটিভি লাগাও। কেউ পরোয়া করে না। যারা থাকে সেখানে তাদের নিয়ে পরোয়া করার কিছু নেই। সেদিন যাদের আলোতে অসুবিধা হত এখন তাদের অসুবিধা হয় না, আলোর মধ্যে তাদের দেখারই তো কেউ নেই। মানুষের অপরাধপ্রবণতা বিবেকের জাগরণে কমে কিনা জানি না, কিন্তু শাসনের চোখ রাঙানিতে না কমলেও যে দমে যায়, এ বাস্তব। কিন্তু অপরাধের সঙ্গে সহবাস অভ্যাস হয়ে গেলে সিসিটিভি, আলো সবটাই বিরক্তিকর লাগে। অসহ্য লাগে। মুক্তিতে বাধা লাগে। যে মুক্তি সভ্যতার সীমা ছাড়িয়ে অন্ধকারে ডানা মেলে সে অন্ধকারকে বলে অসীম। আলোকে বলে বড্ড স্পষ্ট, বিরক্তিকর। জাজমেন্টাল। গোটা কলোনী এখন নন-জাজমেন্টাল এক গভীর অন্ধকারে ডুবে। আজও কৃষ্ণচূড়ার আড়ালে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে… কিন্তু কেউ দেখার নেই। মানে দেখার অবস্থায় নেই।