উঠে বসে চশমাটা খুঁজতে শুরু করল হাতড়ে হাতড়ে। রাত দুটো। বৃষ্টির শব্দটা তুমুল। সাথে ঝোড়ো হাওয়া। জানলার কাঁচটা আটকাতে হবে। পা ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু চশমাটা?
হাতটা একটা ঠাণ্ডা কিছুর গায়ে লাগল। হিম ঠাণ্ডা। কারোর শরীর এত ঠাণ্ডা কি করে হয়? মৃত শরীর? চঞ্চল জানত এটা হবে। আজ রাতে শুতে আসার আগেই তার মনে হয়েছিল আজ রাতে তার পাশে একটা মৃত শরীর শুয়ে থাকবে। চঞ্চল ভয় পায় না। তার বয়েস ষাটের কাছাকাছি। বহু মৃত মানুষের সঙ্গ করেছে এক বছরে। রেণুকা মারা যাওয়ার পর প্ল্যানচেট শুরু করে। তারপর থেকে অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। রাতে কেউ না কেউ আসেই। মুশকিল হয় যেতে না চাইলে। সারাদিন দরজা জানলা খুলতে দেয় না। কখনও খাটে, মেঝেতে শুয়ে থাকে, অথবা সিলিং-এ টানটান হয়ে শুয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে তাকে লক্ষ্য করে যায়। এসব গা সওয়া হয়ে গেছে চঞ্চলের।
হাতটা মৃত শরীরের গায়ে বোলালো। ছেলেদের শরীর। গলার কাছ থেকে নেই। হাতটা ভিজে ভিজে লাগল। রক্ত লেগেছে মনে হল। উফ্... চশমাটা যে কোথায় গেল?
মাথার কাছের টেবিলে কি? মাথার কাছের টেবিলে হাতড়াতেই কারোর মুখে হাত ঠেকল। এমন সময় একটা জোরে বিদ্যুৎ চমকালো। আবছা দেখল ছেলেটার মাথাটা টেবিলের উপর রাখা। চশমাটা কি ওর মুখের মধ্যে? হাতটা ধীরে ধীরে কাটা মাথাটার কাছে নিয়ে গেল। মুখের মধ্যে হাত দিল। দাঁত, জিভ বুঝতে পারছে। এই তো চশমা। যেই চশমাটা হাতে নিয়েছে পাশের শরীরটার থেকে হাতটা উঠে এসে ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। কাটা মাথাটা ফিসফিস করে বলল, দেখতে দেব না আমায়!
চঞ্চল বুঝল, সদ্য মারা গেছে। আত্মহত্যা নিশ্চয়। তাই এত ক্ষোভ, রাগ। অ্যাক্সিডেণ্টে যারা মারা যায় তারা সাধারণত একমাস ওই জায়গাটা ছেড়ে নড়ে না। মানে যেখানে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আত্মহত্যায় তা না, ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।
মাথাটা আবার নড়ল, বলল, সাঁতরাগাছির লাইনে কাটালাম নিজেকে।
চঞ্চল বলল, কেন?
শেফালির বিয়ে দিয়ে দিল।
চঞ্চল দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসল। এ জানা কেস। হ্যাজাবে এখন। বোরিং। চঞ্চল বলল, আচ্ছা। আমায় ঘুমাতে দাও, বিরক্ত কোরো না। বলে পা'টা ছড়াতে যাবে, আরেকটা শরীরে টাচ করল।
মাথাটা বলল, শেফালি। উঠিয়ে নিয়ে এসেছি। গলা কেটে খুন।
কে করল?
আমি। লাইনে শোয়ার আগে।
বৃষ্টিটা খুব জোরে নেমেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন। চঞ্চলের মাইনাস সাত পাওয়ার। তাও সামনের বডিটা বোঝার চেষ্টা করল। নগ্ন না। মানে এটা ডেডবডি। ভৌতিক শরীর না। আত্মা খুব চাইলে নিজের ছেড়ে আসা শরীরের মত ছায়া শরীর বানাতে পারে কয়েক বছর। যেমন এই ছেলেটার। কিন্তু মেয়েটার তো আসল বডি। আনল কি করে? জানলা দিয়ে নিশ্চই। জানলাটা বিশাল বড়। খোলা। কোনো জাল নেই।
চঞ্চল উঠল। ছেলেটার বডি ডিঙিয়ে মেঝেতে পা দিল। পাশের ঘরে যাওয়ার দরজাটা ভেজানো থাকে। একটু ঠেলতেই খুলে গেল। রেণুকার মৃতদেহটা ঝুলছে। আজ কত বছর হল তার মনে নেই। রেণু তাকে শাস্তি দেয় এভাবে। রোজ রাতে ঝুলে থাকে। মাঝে মাঝে দেওয়ালে লাথি মারে। সে পাশের ঘরে শুয়ে শুয়ে শুনতে পায়। রেণুর সন্দেহ করার রোগ ছিল।
হ্যালো লালবাজার?
হ্যাঁ
কমল ডিউটিতে এসেছে?
একটু ধরুন।
কমল?
হ্যাঁ বল,
সাঁতরাগাছিতে.....
দশ মিনিট বাদে লালবাজার থেকে ফোন। হুঁ, দু'দিন আগে, প্রত্যয়, এম এ পাশ। বেকার। মেয়েটার বাড়ি মধ্যমগ্রামে। মিসিং ডায়েরি আছে।
চঞ্চল প্ল্যানচেটে বসল। শেফালি এলো। রেণুকাও পাশে বসল। প্রত্যয়ও।
কি চাও? চঞ্চল জিজ্ঞাসা করল শেফালিকে।
শেফালি বলল, হরলিক্স বিস্কুট। ম্যাঙ্গো, বা মাজা।
চঞ্চল বুঝল মেয়েটার মাথায় সমস্যা ছিল। এটা আরো তিন মাস থাকবে। পুরোনো ডেটা মুছতে সময় লাগে। অ্যাভারেজ তিন মাস।
চঞ্চল উঠে এসে বাইরের ঝুল বারান্দায় দাঁড়াল। ঘুমন্ত কলকাতা। অসুস্থ কলকাতা। অসুস্থ পুরো জগৎটাই। ঘরে রেণুকা, শেফালি আর প্রত্যয়। রেণুকা শেফালির সাথে কথা বলছে। শেফালি হো হো করে হাসছে। একটা প্রশ্ন। ঘরে ঢুকতেই পায়ের কাছে চশমাটা পেলো। চঞ্চল সেটা পড়তেই বুঝল বাঁ কাঁচটা ফেটেছে। প্রত্যয়কে জিজ্ঞাসা করল, তুমি জানতে তো ওর মাথা খারাপ, তাও বিয়ে করতে ওকে?
ওর মাথা খারাপ না। ওর অসুখ। চিকিৎসা করলে ঠিক হয়ে যেত।
আচ্ছা, তুমি ওর বডিটা সরিয়ে দাও, আমি ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি।
প্রত্যয় শুনল। বডিটা নিয়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। শেফালির আত্মা গেল না। সে এসে চঞ্চলের পাশে শুলো। বলল, আমায় চুমু খাও।
চঞ্চল বুঝল, এ রেণুকার খেলা। সেই আদিম নোংরা খেলা। তাকে পরীক্ষা করার। দেখল বাথরুমের পাশে রেণুকা দেওয়ালের উপর শুয়ে। তার দিকে তাকিয়ে।