সৌরভ ভট্টাচার্য
15 March 2018
ছেলেটা একটা কেঁচো হাতে ঝুলিয়ে সুরো'র কাছে এসে দাঁড়ালো।
"মা, এর মুখটা কোনদিকে?"
সুরো কাপড় কাঁচতে কাঁচতে বলল, জানি না, ফেল ওটাকে পুকুরে।
ছেলেটা একবার কেঁচোটাকে মুখের কাছে তুলে নিয়ে দেখল। তারপর ধীরে ধীরে জলে ফেলে দিল।
সুরো'র আরো দেরি আছে। দুপুর আড়াইটে হবে। গদা স্কুল থেকে আর বাড়ি ফেরেনি। মা'কে পুকুরধারে দেখেই এদিকে চলে এসেছে। মায়ের দেরি আছে দেখে গদা পাশের আমগাছটায় চড়তে শুরু করল। আমগাছটা ভরতি বোল। চকচক করছে ওটা কি? আরে, সাপ তো? সামনের ডালটা বেঁকে যে ডালটা উপরের দিকে ডানদিকে গেছে তার উপরে শুয়ে আছে।
গদা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। ওর ল্যাজটা ধরবে। পাতাগুলো সরিয়ে সরিয়ে এগোতে হবে। নইলেই পালাবে।
সুরো চমকে উঠল বেলার চীৎকার শুনে, ও বৌদি... দেখো গদা...
সুরো এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। গাছের নীচে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে বলল, গদা... ছাড় বলছি... ছেড়ে দে ওটাকে... এগোস না...
গদা ইশারা করে দেখালো, চুপ!
বেলা বলল, বউদি আমি শাড়িটা ছেড়ে সালোয়ার কামিজটা পরে আসি, ও শুনবে না।
সুরো ভয়ার্ত চোখে বেলার দিকে তাকালো। কি বলবে বুঝতে পারছে না। আশেপাশেও কাউকে দেখছে না।
বেলা দৌড়ে বাড়ির দিকে গেল। সুরো আরো কয়েকবার চীৎকার করল। গদার থেকে আর কয়েক আঙুল দূরেই সাপটা।
হঠাৎ তুমুল ঝড় উঠল। সুরো খেয়াল করেনি কখন কালো মেঘ করে এসেছে পশ্চিম দিকটায়। কালো হয়ে গেল মুহূর্তে চারদিক। হুড়মুড়িয়ে ঝড় উঠল। গাছটা এলোপাথাড়ি দুলতে লাগল। ছেলেটা গাছের উপর থেকে চীৎকার করে কেঁদে ওঠার মত বলল, "মা!"
বেলা এখনও আসছে না কেন। সুরো'র মাথাটা টলছে। সে মাটিতে বসে পড়ল হাঁ করে উপরের দিকে তাকিয়ে। ধুলোয় ধুলো চারদিক। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিলু, তার বর, ক্ষেতে। খানিক আগেই ভাত দিয়ে এসেছে বেলা।
বেলা এলো। সে গাছে চড়তে জানে। কিন্তু এত ধুলো, এত দুলছে গাছের ডাল --- সুরো কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। হঠাৎ তার কানে গেল, পিসি তাড়াতাড়ি ওঠ, আমায় নামা, ভয় করছে ভীষণ আমার।
বেলা গাছে উঠতে যাবে, সুরো এসে হাত চেপে ধরল। তুই উঠিসনি বেলা। আশ্চে হপ্তায় তোর বিয়ে। কত ধার করে তোর দাদা সব জোগাড় করেছে তুই জানিস? আজ যদি পড়ে তোর একটা কিছু হয়?... তুই উঠিসনি। ঝড় থেমে গেলে ও নিজেই নেমে আসবে'খন, আয় বাকি কাপড়গুলো ধুয়ে নিই বরং..
বেলা এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তুমি কি পাগল হলে বৌদি? ছেলেটার পড়ে যদি কিছু হয়...! বেলা উপরের দিকে চীৎকার করে বলল, তুই ঘাবড়াসনি বাবু, আমি আসছি।
বেলা ধীরে ধীরে গাছে উঠতে লাগল।
"পিসি এদিকপানে... পিসি এই যে... এই যে আমি..."
বেলা নিজেকে টেনে হিঁচড়ে যে ডালটায় গদা বসেছিল সেটাতে উঠল। গদার হাতে জড়ানো সাপটা। বেলা কিচ্ছু বলল না। গদা বলল, ও ভয় পেয়েছে, ওর বাড়ি কি এই গাছেই রে পিসি?
বেলা দেখল সাপটা একটু একটু নড়ছে মাঝে মাঝে। কিন্তু কিচ্ছু করছে না ছেলেটাকে। সে একবার পাতা সরিয়ে বৌদিকে দেখার চেষ্টা করল। এত ঘন পাতা আর বোল যে, নীচটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তার উপর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
বেলার সামনে বিয়ে। দাদা অনেক টাকা কর্জ করেছে। সাপটা বিষধর। ডালটাও বেশ উঁচুতে। বেলা হাত বাড়িয়ে বলল, দে সাপটা আমার হাতে দে।
গদা বলল, না। ও ভয় পাবে। তুই পিসি একটা খাঁচা বানিয়ে দিবি? একে পুষব।
পিসি বলল, আচ্ছা সে হবেখ'ন। ইতিমধ্যে একটা জোরালো বিদ্যুৎ চমকালো। গদা বেলাকে জাপটে ধরতে গিয়ে সাপটা ছিটকে পড়ল নীচে।
বেলা চীৎকার করে বলল, বৌদি সাপ, তোমার দিকে!
কোনো উত্তর এলো না। বেলার বুকটা ধড়াস করে উঠল। সে একটু অপেক্ষা করে গদাকে ধরে ধীরে ধীরে নীচে নামাতে লাগল। গদা বলছে, পিসী সাপটার গা কি ভেঙে গেছে নীচে পড়ে? ও কি রেগে মা'কে কামড়ে দেবে?
বেলা নীচে নেমে দেখে সুরো পুকুরপাড়ে হাঁটুর ওপর মাথা রেখে বসে। জলে ভিজছে সারা গা। বেলা কাছে গিয়ে ডাকল, বৌদি, অ্যাই বৌদি... এই দেখো গদা... সব ঠিক আছে গো...
সুরো চকিতে উঠে দাঁড়িয়ে বেলা'র মুখের দিকে তাকালো। তারপর তাকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে বলল, তোর দাদা অনেক টাকা ধার করে ফেলেছে রে.. তোর কিছু হয়নি তো.. তুই বাড়ি চ...
তারপর হঠাৎ সামলে নিয়ে বলল, তবে তুই না চাইলে বিয়ে করবিনি, লোকটাকে আমারও তেমন পছন্দ নয়, তোর থেকে বিশ বছর প্রায় বড়... বিয়ে করতেই হবে তার কি মানে আছে... সেলাই শিখবি... নিজের টাকায় নিজে বাঁচবি.. পারবিনি...? কিরে বেলা বল...??
বেলা চুপ করে থাকল। তারপর গদা'র দিকে তাকিয়ে বলল, একটা খাঁচা বানাব আমরা, তাতে আমি আর তুই কি পুষব বল তোর মাকে...
গদা লাফিয়ে হাততালি দিয়ে বলল, সাপ!
অন্ধকার হয়ে এসেছে। ঝড় থেমেছে। বিদ্যুৎ চমকালো জোরে। সেই চকিত আলোয় বেলার মুখটা বোঝার চেষ্টা করল সুরো... তারপর হনহন করে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। পিছনে পিছনে গদা আর বেলা। গদা সাপটাকে খুঁজছে, বেলা একবার আকাশের দিকে তাকালো। মেঘ কেটে চাঁদ উঠেছে।