উবু হয়ে, লুঙ্গিটাকে গুটিয়ে হাঁটুর কাছে এনে, বসে আছেন। বয়েস ষাটের আশেপাশে হবে। রাস্তার পাশে একটা পাঁচিলের ধারে বসে। খেটে খাওয়া শরীর ছিল এককালে দেখলেই অনুমান হয়। বিকেলবেলার পশ্চিম ঢলা রোদ ওনার ভাঁজ পড়া মুখে।
রাস্তা দিয়ে নানান লোকের চলাচল। তিনি তাকিয়েও তাকাচ্ছেন না। উদাসীনতায় বিষন্নতার দৃষ্টি। আচমকাই একজন মাঝবয়সী মহিলাকে রাস্তার মোড়ে দেখা গেল। সাথে সাথেই বসে থাকা দু'টো চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। স্থির অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উনি মহিলার দিকে। সাথে কি একটা যেন খুঁজছেন। বিকালের পড়ন্ত আলোয় দৃষ্টিশক্তির সাথে দেখার আগ্রহটার যেন মিল করতে পারছেন না।
হঠাৎই মহিলাটির পিছু পিছু একটি চঞ্চলা শিশুর আবির্ভাব হল। তার পা স্থির নয়। মায়ের সাথে দূরত্ব বাড়ানো কমানোর খেলা খেলতে খেলতে হাঁটছে। সাদা ফ্রকের কিছুটা ধূলো মাখা। তবে শিশুটির সাথে সে ধূলো কোথাও বেমানান লাগছে না। মনে হচ্ছে এই বেশ। পুরো ধবধবে সাদা ফ্রকেই যেন সে বড্ড বেমানান হত।
ক্রমশ তারা অপেক্ষারত মানুষটির সামনে এসে পড়ল। বৃদ্ধ মানুষটার ঘাড় শক্ত হয়ে উঠল, চোখদুটো এক অব্যক্ত অভিমানে জ্বলজ্বল করে উঠল। মনে হল এই খণ্ড দৃশ্যটুকুর জন্য যেন তিনি অনন্তকাল ধরে অপেক্ষায় ছিলেন। থাকবেনও।
তিনি ইশারায় বাচ্চাটাকে কিছু বললেন। বক্তব্যের চেয়ে স্নেহের ব্যঞ্জনাই বেশি। বাচ্চাটা তার মায়ের আঁচল চেপে ধরে, নিজের না চলতে চাওয়া পা দু'টো হেঁচড়ে হেঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে চলল। তার সমস্ত চঞ্চলতা মুখের মধ্যে একটা অবাধ্য বায়নার মত যন্ত্রনায় ফুটে উঠতে লাগল। সে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, আঙুলের ইশারায় অস্ফুটে বলল, "দাদু"। মা চোয়াল শক্ত করে হাঁটার বেগ ত্বরান্বিত করার ভাণ করলেন বলেই মনে হল। ভঙ্গী যতটা সত্য হল, বেগ ততটা হল না।
এ ক্ষুদ্র খণ্ড নাটিকাটি শেষ হতে এক মিনিটেরও বেশি সময় হয়তো লাগল না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল। মুখগুলো ঝাপসা এখন। কার চোখের কোল কতটা ভিজল বলতে পারি না। তবে বাচ্চাটার বুঝতে আরো অনেকগুলো সন্ধ্যে লাগবে বোঝা গেল - তারা ভিন্ন হয়েছে। কাছের মানুষ অনেক দূরের হয়ে গেছে, হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে না এখন।
বুঝে যাবে। তবে খানিক সময় লাগবে, এই যা।