এই তো আবার ঝড় আসবে। সমস্ত ধাতব তারের বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন হবে দুর্ঘটনা এড়াতে। ঘরের মধ্যে গুটি গুটি পায়ে হাঁটু মুড়ে বসবে আদিমযুগের গুহার অন্ধকার। আমরা তাড়াহুড়ো করে মোমবাতি, হ্যারিকেন, লম্ফ জোগাড় করে যতটা পারি আলো জ্বালাব। মোবাইলের চার্জ বুঝেশুনে খরচ করব, যদি আজ কারেন্ট না আসে! তখনও বাইরে ঝড়। ছাদে ওঠা যাবে না, যদি কোনো উড়ন্ত টিনের চালা বা গাছের ডাল উড়ে আসে। বৃষ্টিও শুরু হল যে! বৃষ্টির ছাঁটে, হঠাৎ ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর খারাপের ভয়। ঝড়ের আঘাতে ঘরে ঢুকে পড়া কিছু বিশ্রী পোকা উড়ে বেড়াচ্ছে তখন মোমবাতির শিখা ঘিরে ঘিরে। ওরা জংলী। ওরা বিষাক্ত। ওরা অভদ্র আদিম। জলের গ্লাসে, চায়ের কাপে, ভাতের থালায় যখন তখন পড়ে যেতে পারে। খুব সাবধান। খুব সতর্ক থাকার সময়। ঘরের ভিতর আলোর চেয়ে অন্ধকারের অনুপাত বেশি। ইনভার্টার বন্ধ থাক, বাজ পড়ছে না!
এখন মাথার মধ্যে অকর্তব্যের ভিড়। মাথার মধ্যে ঝোড়ো বেয়াড়া অশাসিত কথারা, ছবিরা, অনাহূত মুখেরা। অতীতের পায়ের ছাপ বর্তমানের তন্দ্রাচ্ছন্ন চেতনার উপর। বিদ্যুতের চমক, বাজের আওয়াজ, বৃষ্টির শব্দ - ওরা মিশে যাচ্ছে তন্দ্রায়। পোকারা মোমবাতির শিখার ভিতর চিরে উড়ে বেড়াচ্ছে। কি মরণখেলা! সে খেলায় শিখা কেঁপে উঠে দেওয়াল জুড়ে অশরীরী ছায়ার কাঁপন জাগিয়ে দিচ্ছে। তবু এখন শুধু তন্দ্রা। আদিম গুহার তন্দ্রা।
বৃষ্টি থামল। মেঘ পরিষ্কার আকাশ। চাঁদ তাকিয়ে ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে। যেন কবিতা। যেন এক টুকরো সুর। সে সুর যেন কেউ অন্যমনস্কভাবে ভাঁজতে ভাঁজতে রেখে গেছে। হারিয়ে ফেলেছে সচেতনভাবে। যেন সে ছিল বৈরাগী, ঝড়ের নৌকায় পাল তুলে এসেছিল। নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঝড়ে ভাঙা ডালপালা, ঝরাপাতা, আমের মুকুল ছড়িয়ে থাকা উঠানে। এত দূরের আলো, অথচ কত কাছের। সব ছল। তবু ছলনার হাত ধরবে কল্পনা। একদিন সে হাত মুচড়ে দেবে জেনেও। ছলনা এমনই, তাকে ফিরিয়ে দিলে অভিমান, রাখতে চাইলে সংশয়। ছলনার বাইরে জীবনই বা কই? সে তো আরো বড় ফাঁদ! ঘোরের ফাঁদ, নিজের মনের বিকারের ঘোর।
কারেন্ট চলে এলো। এক মুহূর্তে আদিমগুহা ছিটকে লুকিয়ে পড়ল অতীতের ভাঁড়ারে। এইবার সব আগের মত। রাস্তার সব আলো, ঘরের সব আলো জ্বলে গেল। টিভি মোবাইল সব জেগে উঠল। আধুনিকোত্তর যুগ গ্রাস করে নিল এক পলকে। পোড়া মোমবাতির পোড়া শিখার গন্ধ মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অনাহূত পোকাদের কয়েকটা মৃতদেহ এদিক ওদিক ছড়িয়ে। বাকিরা পালাবার পথ খুঁজছে। আদিম জগতে ফেরার রাস্তা হারিয়েছে আলোর ধাঁধায়। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু এগোচ্ছে ধীরে ধীরে।
তন্দ্রা কেটে গেছে। ব্যস্ততা জাল বুনছে আমায় ঘিরে ঘিরে। এও ছল। বেঁচে থাকার অত্যাধুনিক ছল। নিজেকে রাঙিয়ে তোলা নিজের চাইতে বড় করে। মানুষের চিরকালের দাবী অমরত্ব, সুখ আর অহংকার। বিজ্ঞান আশ মিটিয়ে দিয়েছে কিছু। আমাদের বিশ্বাস সে আরো দেবে, ঈশ্বরের অভাব পূর্ণ করে।
তবু মাঝে মাঝে ঝড় আসে। আসবেও। কারণ কেউ কেউ অপেক্ষা করে থাকে ঝড়ের, তন্দ্রার আর কিছু আদিম পোকার শিখার আলোয় পুড়ে যাওয়ার। এও অবশ্যম্ভাবী, ঝড় জানে। জানি আমি। তুমিও।