Skip to main content

দুটো দেওয়ালের খাঁজে ঝুলটা অনেকদিন ধরেই আছে। মম তাকায়। সরাতে চায় না। ছোটো একটা মাকড়সা এক কোণে বসে থাকে। মমকে দেখে। মমকে বলে, আমি তো পাঁচিলের এক কোণে আছি দেখো। তোমাদের এতবড় বাগান, আমার কি একটুও জায়গা হবে না?

মম কিছু বলে না। মম আসলে কথা বলতে পারে না। সেদিন ঝুলের উপর একটা ফুল এসে পড়েছিল। কি ফুল মম জানে না। কোথা থেকে উড়ে এসে পড়েছে। এ বাগানের ফুলই নয়। মম ভালো করে তাকিয়ে দেখল। ফুলের রেণু গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে আছে ঝুলের এদিক ওদিক। বিকেলের আলো এসে পড়েছে ঝুলের উপর। মমর মনে হল এই বিকেল, এই আলো, এই ঝুলের উপর এমন সাদা আর নীলে মেশা ফুল সে আগেও দেখেছে। অন্য কোনো যুগে।

পরেরদিন ভোরে মম এসে আবার দাঁড়ালো ঝুলের সামনে। শিশিরবিন্দু জমে যেন মুক্তাহার। ফুলের পাপড়িগুলো শুকিয়ে গেছে। এরই মধ্যে! মমর মনটা খারাপ হল। মমর কাছে জগতটা নিঃশব্দ। এই যে পাতাগুলো মাঝে মাঝেই এমন অস্থির হয়ে ওঠে, তার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা যেমন ধড়ফড় করে ওঠে তেমন, তার কি শব্দ? জানে না সে। মায়ের গলার ডাক, বাবার গান, পাখির আওয়াজ, জলের আওয়াজ কিছুই শোনেনি সে। বাবার তানপুরাটার তারে হাত বোলায়। সুর ওঠে নিশ্চিয়ই। সে শুনতে পায় না। দেওয়াল শুনতে পায়, ধুলোপড়া পাখা পায়, সোফারা পায়। এত বড় বাড়ির নৈঃশব্দতাকে মম শুধু নিজের বলে পায়। সেই শুধু তাকে বোঝে।

মম শুকনো ফুলটা তুলল। অল্প একটু ঝুল লেগে গেল হাতে। একটা শুকনো পাতা দিয়ে ছাড়িয়ে নিল। কুয়োতলায় এসে জল তুলে হাত ধুলো। পায়ে জল দিল। আবার এসে ঝুলটার সামনে দাঁড়ালো। মাকড়সাটা গুটিসুটি মেরে একদিকে বসে। ভয় পায় না সে মমকে। জানে তার বাসা সে ভাঙবে না। যেটুকু ভেঙেছে সে আবার বানিয়ে নেবে।

মম বাগানের মধ্যেখানে যে সিমেন্ট বাঁধানো বসার জায়গাটা সেখানে এসে বসল। চতুর্দিকে ঝরাপাতা। ঘাস দেখা যাচ্ছে না। শুকনো পাতা মাড়ালে কেমন শব্দ হয়? শব্দ হয়। নইলে সেদিন বেড়ালটা চমকে উঠল কি করে, যেই না মম শুকনো পাতায় পা রেখেছে অমনি? বেড়ালটা তার নয়। মম কিছুই পোষেনি জীবনে। না পশু, না ভালোবাসা। নিজেকেও পোষ্য হতে দেয়নি কারোর। জীবনকে পোষা যায় না। জীবনকে তার স্রোতে ছেড়ে দিতে হয়। আজ এই একান্ন বছর বয়সে এই সত্যকে রোজ দেখতে পায় বাগানে। বাগানে ঋতু পরিবর্তন হয়। এক এক ঋতুতে এক এক ফুল, এক এক রঙ, এক এক গন্ধ, এক এক পাতার সাজসজ্জা। কেউ স্থির নয়। কেউ কাউকে আটকায় না। কেউ বায়না করে না আরেকটু থেকে যাও বলে। সবাই আসে আর যায়। মম সন্ধ্যবেলা যখন ছাদে বসে। এক আকাশ তারা যেন ভেলা ভাসিয়ে অন্ধকারের নদীতে আসে। মম নিজেকে জিজ্ঞাসা করে, তীর দেখতে পাচ্ছিস মম আর কতদূর? মম উত্তর পায় না। কান পেতে থাকে। জলের শব্দ কেমন জানে না মম, কিন্তু অপেক্ষার শব্দ তার পাঁজরে এসে বসে। পক্ষী শাবকের মত তার দিকে হাত বাড়ায়। মম জীবনকে বলে, আচ্ছা, তুমি ধীরে ধীরেই এগোও, আমার কোনো তাড়া নেই।

সন্ধেবেলা আকাশ ঘিরে এলো কালো মেঘ করে। দেখতে দেখতে এলো তুমুল ঝড় আর বৃষ্টি। মম বাড়ির সব জানলা দরজা লাগাতে লাগাতে মনকে বলতে লাগল শান্ত হ, মন শান্ত হ। মম শান্ত হ।

মমর ঝড়কে ভীষণ ভয়। ঝড়ের মধ্যে যে জুলুম তাকে সে সহ্য করতে পারে না। তার বাগানকে কতবার তছনছ করে চলে গেল। এত জুলুম! এত এত কেন? মম মোমবাতি জ্বালিয়ে কাঁচের জানলার পাশে বসে। বাইরে তাণ্ডব চালাচ্ছে ঝড়। দরজা জানলা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মম বাবার তানপুরাটা কোলের উপর নিল। মধ্যমা দিয়ে তারগুলোর উপর তুলল সুর। ঝড়কে ভয় দেখাবে। ঝড়কে অপ্রস্তুত করবে। মায়ের শাঁখ নিয়ে এলো ঠাকুর ঘর থেকে। দিল ফুঁ। ঝড়কে সাবধান করবে সে।

ঝড় থামল। টর্চ হাতে মম বেরোলো বাগানে। তছনছ হওয়া বাগান। মমর কান্না পেলো। মেঘ কাটল। চাঁদ উঠল। চাঁদের আলো মাটিতে পড়ল বৃক্ষের পাতার ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে। যেন আলো ছায়ার আলপনা আঁকা হল। পাতা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে জল। ডানা ভেজা পাখিরা ডানা ঝাপটিয়ে জল ঝেড়ে ফেলছে একে একে। মম টর্চটা জ্বেলে এসে দাঁড়ালো ঝুলের সামনে। কোথায় ঝুল? কিচ্ছু নেই। সব পরিষ্কার। কে বলবে এখানে একটা প্রাণের বাসা ছিল এই খানিক আগেই। কত সপ্তাহ, মাস ধরে সে অল্প অল্প করে বানিয়েছিল তার ঘরবাড়ি। সব মুছে গেল এক লহমায়।

মম টর্চটা বন্ধ করে এসে বসল ভেজা বসার জায়গায়। চাঁদের আলো উদাসীন। এই যে এত ঝড় হল। এই যে বাসা ভেঙে গেল এতগুলো। তারারা উদাসীন। মম মনকে বলল উদাস হ মন। একলা একলা আকাশের মত হ।

মমর চোখের কোল বেয়ে নামছে জল। বুকের মধ্যে তবু ঝড়। মম মনের ভিতর তুলছে তানপুরার ছড়। শাঁখের আওয়াজ। মম মনকে জিজ্ঞাসা করছে, তীর দেখতে পাচ্ছিস মন? মম তোর তীর এলো? ভেলা বাঁধবি তীরে?

উত্তর নেই। শিশিরে ভিজছে মাথা। মমর সাদা সিঁথি বেয়ে জমছে শিশিরদীঘি। বিন্দু বিন্দু। চাঁদের আলোয় জমছে মুক্ত। মম চোখ বন্ধ করে বসে। বাবা গান গাইছে। রাগ বেহাগ। মা তরকারি কাটছে। আজ রাতে হবে খিচুড়ি আর বেগুনী। মম গন্ধ পাচ্ছে মায়ের আঁচলের। রান্নার। মম ঘুমিয়ে পড়ল। ঝড়ের পরে ঘুম পায়। এ ঘুম ক্লান্তির না, উত্তরণের।