আসলে সবাই জানে ঈশ্বরকে বোকা বানানো যায়, নইলে এত মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয় নাকি? তার মানে এত মানুষ সৎ? এত মানুষ দয়াবান? হুস্...! তাকি হয়?
একটা বড় শুকনো ডাল হাতে তুলে এই কথাটাই মনে হল জবার। মনে হওয়ার কারণও আছে, সকালে একগ্লাস ছাতু খেয়ে বেরিয়েছিল কাঠ কুড়াতে, এ রোজকার কাজ। কিন্তু রোদটা এত চড়া, একটু হেঁটেই মাথাটা ঘুরাতে শুরু করল। গঙ্গার এদিকে ঘরবাড়ি কিচ্ছু নেই, একটা ভাঙা শিবমন্দির আছে। সেই মন্দিরের চাতালে কাঠকুড়ানোর ঝুড়িটা রেখে বসেছিল অনেকক্ষণ। কি অবস্থাটা মন্দিরটার! দেওয়ালটা ভেঙে গেছে বটগাছের শিকড়ের জন্য। শিবের সারা শরীর বেয়ে লাল পিঁপড়ের সারি। কে কবে একটা বাতাসা রেখে গেছে সেটা শুকিয়ে সাদা গুঁড়ো হয়ে আছে। এদিক ওদিক ঝোপ উঠে গেছে মন্দিরে। এটা ব্যানার্জি বাড়ির মন্দির ছিল। ওরা সব কলকাতায় গেল। ব্যস, পুজোপার্বণও উঠে গেল। শিবরাত্রির দিন আগে তাও কয়েকজন আসত। এখন বড়রাস্তার মোড়ের পাশে একটা লোকনাথ মন্দির হয়েছে ওখানেই সব যায়। জবা অবশ্য এখনও এখানেই আসে জল আর দুটো মিষ্টি নিয়ে। একটা মিষ্টি রেখে যায়, আরেকটা নিয়ে যায়।
শিবকে দেখলে বড্ড অসহায় লাগে জবার। মেয়েমানুষ পাশে না থাকলে সব পুরুষই ক্যাবলা, সে দেবতা হলেই কি আর মানুষ হলেই কি।
আজ মনটা বড্ড উদাস। গঙ্গার দিকে তাকিয়ে অশ্বত্থ গাছের শিকড়ের উপর বসল। শরীরটা কেমন লাগছে। মনে হয় কাল থেকেই শুরু হবে, নয় তো আজ বিকাল থেকেই। মেয়েমানুষের ঝক্কি। বাবুর মুখটা মনে পড়ল। মিষ্টির দোকানে কাজ করে। মাসে দেড় হাজার টাকা দেয়। ক্লাস সেভেন অবধি পড়ল। যদি পড়ত তবে এবার মাধ্যমিক দিত। আর পড়াশোনা!
জবা নিজে পড়াশোনা করেনি। তবে অক্ষর চেনে। নিজের নাম সই করতে পারে। বিয়ের দু'দিন পর ব্যাঙ্কে নিয়ে গিয়েছিল যখন জগু, জবা নিজের নাম সই করছিল দেখে মুখটা গর্বে ভরে গিয়েছিল। ব্যাঙ্কের অফিসার বলেছিল, কি জগা তোমার বউ তো বেশ শিক্ষিত।
আর শিক্ষা! রাজনীতির কি একটা ঝামেলায় পড়ে আর পাঁচ বছর হল সে ফেরার। খুনের মামলা। খুন যে করতে পারে না জগু এ জবার বিশ্বাস হয় না। চাইলেই খুন করতে পারে। শরীর জাগলে পাগলা ষাঁড় জগু। যাকে খুন করেছে সে অন্য পার্টির। তার বউয়ের সঙ্গে নাকি জগুর সম্পর্ক ছিল। তার বিয়ের আগে থেকেই। ভয়ে জিজ্ঞাসা করেনি জবা এই নিয়ে কিছু। তার বউকে দেখেছে, কালো। জবার গায়ের রঙ তার থেকে খোলা। তবে শরীরে গড়ন আছে। জবা বড্ড রোগা।
জলতেষ্টা পাচ্ছে। কাঠগুলো এক জায়গায় জড় করে রেখে গঙ্গায় নামল। জবা সাঁতার জানে। শরীরে তার জলের টান। জলের গভীরতায় ডুবে যেতে ইচ্ছা করে। জলে মিলিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। জবা হাঁটু অবধি শাড়িটাকে তুলে গঙ্গায় নামল। দু' আঁজলা জল মুখে দিয়ে, চোখে-মুখে জলের ছিটে দিয়ে তাকালো ওপারের দিকে। জল রোদে চিকচিক করছে। যেন সোনা গলিয়ে ফেলেছে কেউ। ওপারে জগুর বোনের বাড়ি। তার একমাত্র ননদ সুজাতা। ওর বর কাঠমিস্ত্রী। ওটা কি?
একটা মড়া ভেসে আসছে। প্রায়ই আসে। গরু, বাছুর। জবা হাতটায় রোদ আড়াল করে ভালো করে তাকালো। মানুষ ভেসে আসছে। পুরুষ।
জবার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। পাড়ের দিকে তাকালো। কোনো মানুষ নেই। একটা কুকুর জিভ বার করে হাঁপাচ্ছে। গন্ধ পেয়েছে। পচা মানুষের গন্ধ। জোয়ার এখন। মড়াটা আসছে ভেসে ভেসে। হঠাৎ জবার মনে হল জামাটা যেন তার চেনা। জগু?!!
মুহুর্তে কি হল জবার। সব বোধশক্তি যেন হারিয়ে ফেলল। মাথাটা আবার ঘুরছে। তবু জলের মধ্যে ঝাঁপ দিল। পাগলের মত সাঁতার কাটছে। কুকুরটা কয়েকবার চীৎকার করে উঠল। প্রাণপণে সাঁতার কেটে ভেসে যাওয়া শরীরটার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বুকের ভিতর শ্বাস যেন ফুরিয়ে আসছে। দেহটাও যেন বড্ড তাড়াতাড়ি ভেসে যাচ্ছে। নাগাল পাচ্ছে না জবা। খানিক যেতে হঠাৎ মনে হল যেন জলের ধারা বদলে যাচ্ছে। হটাৎ যেন স্রোত বেড়ে যাচ্ছে হুহু করে। জামাটা চেনা জবার। দেহটা প্রায় কাছাকাছি। মুখটা জলের মধ্যে ডোবানো। আর কিছুটা। আর কিছুটা। কয়েকটা কাক বসেছে। হুস হুস্... জবার শ্বাস যেন ফুরিয়ে আসছে।
হঠাৎ মনে হল নদী না, সে যেন সমুদ্রে এসে পড়েছে। এতো জোয়ার না, বান! জবা দেহটার পা খামচে ধরল। তার মনে হচ্ছে সে যেন ডুবে যাচ্ছে। শ্বাস পাচ্ছে না আর বুকে। আকাশের দিকে একবার তাকালো, কয়েকটা চিল উড়ছে। সাদা সাদা মেঘ কয়েক টুকরো। শরীরটা ছেড়ে যাচ্ছে জবার। শিথিল হয়ে যাচ্ছে হাত-পা। জলের নীচে ডুব দিলেই মুখটা দেখতে পাবে, এ জগু। নিশ্চয়ই জগু। পুরুষের পাশে কোনো মেয়ে না থাকলে বড় বোকা হয় পুরুষ।
[ছবিঃ সুমন]