Skip to main content

দাদা, হয়ে গেছে, আসুন।

 

পরিতোষ আকাশের দিকে তাকিয়ে, গঙ্গার জলে পা ডুবিয়ে বসেছিল। তার একমাত্র মেয়ে, পনেরো বছর বয়েস, তার পুড়ে যাওয়া শেষ। এবার তার নাভি খুঁজতে নামবে ডোম। সারাজীবন কত মানুষের নাভি সে কুড়িয়েছে কে জানে? জাহ্নবী চলে যেতোই। তার রোগের চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি যে। একজন মানুষ আর কতদিন বিছানায় বন্দী হয়ে কাটাতে পারে? বরং ভাবনা ছিল, সে চলে গেলে রাখি মেয়েটাকে নিয়ে একা পারবে?

পরিতোষ উঠল না। আরেকটু পরে উঠবে। তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ছিল। কত মৃত্যুশোক পেয়েছেন মানুষটা। বেলা? তাঁর মেয়ে তো? তবে?

পরিতোষ উঠল। সবাই বলে, দাদা আপনার চেহারাটা কিন্তু ভেঙে গেছে। এত মানসিক চাপ আপনার!

পরিতোষ জানে না চেহারা ভাঙা কাকে বলে। ওজন কমে যাওয়া? গাল তুবড়ে যাওয়া? পাঁজর বেরিয়ে যাওয়া? মানুষ এত সামান্য জিনিস নিয়ে কেন এত মাথা ঘামায়? তার চেহারা তো ঠিকই আছে। মানুষ কোন চেহারা দেখে?

পরিতোষ নাভিটা অন্ধকার গঙ্গায় ভাসিয়ে দিল। মা, বাবাকে মনে মনে বলল, ও গেল, দেখে রেখো।

====== ======= ======= =========

 

ভোরের আলো ফুটল। জাহ্নবীর ঘরের দরজা দিয়ে আলো এসে পড়ে। জাহ্নবী সকালে উঠে স্তব বলত। বাবা শিখিয়েছিলেন। স্পষ্ট উচ্চারণ না। আত্মীয়স্বজনরা এলে বাবা জোর করে শোনাতেন, জাহ্নবীর স্তব। আত্মীয়রা অধৈর্য হত। চা ঠাণ্ডা হত। চপ, সিঙ্গারা ঠাণ্ডা হত। মাছি বসত। জাহ্নবী জিভ জড়িয়ে জড়িয়ে তার অবুঝ ঠাকুর্দার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে স্তব বলে যেত। ঠাকুর্দার মুখ উদ্ভাসিত। কে বলে তার নাতনি পারে না। এই তো পারে। রাখি উদাস মুখে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকত। নখ কাটত দাঁতে। অপ্রস্তুত লাগত ওর নিজেকে। পরিতোষ সবাইকে খেয়াল করত। এক একবার মনে হত সে বলে, আপনারা একটু মন দিয়ে শুনুন প্লিজ, ও বেশিক্ষণ সময় নেবে না। রাখি আবার চা করে নিয়ে আসবে। গরম চা। আপনারা একটু মন দিয়ে শুনুন প্লিজ। চপ, সিঙ্গারা আমি মাইক্রোওভেনে আবার গরম করে নিয়ে আসছি। আপনারা শুনুন প্লিজ। ওই মেয়েটার জন্যে না হলেও ওই বৃদ্ধের জন্য অন্তত শুনুন। মেয়েটা তো বোঝে না প্রশংসা, নিন্দা, উপেক্ষা, উপহাস মানে কি, কিন্তু ওর ঠাকুর্দা যে বোঝে, প্লিজ শুনুন। আপনারা শুনলে পরবর্তীকালে নিজেদের এই আত্মত্যাগ মনে করে আপনারা কোনো দুঃসময়ে ঈশ্বরের কাছে অতিরিক্ত আস্কারা দাবি করতে পারবেন। নিজেদের দিকে তাকিয়ে অন্তত এইটুকু করুন। পারবেন না?

এ কথাগুলো কাউকে কোনোদিন বলা হয়নি। আজ শ্মশানে যত মানুষ গিয়েছিল, তারা সবাই না হলেও, বেশিরভাগ মানুষ মনে মনে বলছে, পরিতোষদা বেঁচে গেলে। চায়ের দোকান চালিয়ে এই রোগের চিকিৎসা চালানো মুখের কথা নাকি? ভগবান নিয়ে নিয়েছেন, ভালো হল, বেঁচে গেলে তুমি আর বৌদি। তোমরা কেন যে আরেকটা ইস্যু নিলে না!

 

====== ======= ======== ========

 

আরেকটা ইস্যু।

নিলেই হত। তবু রাখি চায়নি, পরিতোষও চায়নি। যদি আবার এরকম হত? এ ভয় তো ছিলই, তার চাইতে ভয় ছিল, যদি জাহ্নবীকে অবহেলা করত তারা! বা বেশি করুণা। অতিরিক্ত করুণাও তো এক রকমের অবহেলা না! তাকে ন্যায্য ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করে তার দিকে বিশেষ অনুভব বাড়িয়ে দেওয়া! সেও তো অবহেলা।

পরিতোষকে অনেকে বলেছে, তারা ভুল করছে। রাখিকেও অনেকে বলেছে। কিন্তু পরিতোষের তা মনে হয়নি। তার বিশ্বাস রাখিরও মনে হয় না।

একবার পুরী গিয়েছিল তারা। তখন জাহ্নবীর পাঁচ বছর বয়েস। কোথাও একটা মির‍্যাকালের আশা ছিল। অনেক মন্দির নিয়ে যেতে চাইত তারা। কিন্তু অর্থে আর সাহসে কুলাতো না। তাই পুরী। বিশেষ পুজো দিয়েছিল। কিছু হয়নি।

পুরীর বীচে জাহ্নবীকে মাঝখানে শুইয়ে রাখি আর পরিতোষ বসে থাকত অনেকক্ষণ। সমুদ্রের গর্জন, মানুষের কোলাহল, পিছনের রাস্তায় গাড়ির হাঁকডাক, সব মিলিয়ে যখন জাহ্নবীর দিকে তাকাতো পরিতোষ, বুকটা অভিমানে ভরে উঠত। এক এক সময় মনে হত তার দোষ, বেশিরভাগ সময়েই মনে হত রাখির দোষ। ওদের পরিবারে নিশ্চয় কেউ আছে, রাখি লুকিয়ে গেছে। তার পরিবারে কেউ নেই সে তো জানে, রাখি কেন বলে না কিছু!

রাখির পরিবারেও কেউ নেই। তবু হল। সমুদ্রের ধারে বসে বসেই মনটা বদলে গিয়েছিল পরিতোষের। মনে হয়েছিল, যা হয়েছে হোক, একে তো ফেলে যাওয়া যায় না। এ দায়িত্ব সে মাথা পেতেই নেবে। সমুদ্রের তীরের মত হবে। সমুদ্রের তীর কি এত ঢেউ চায় রাতদিন? কিন্তু তবু সয়ে যায় তো। সেও সইবে।

সেদিন থেকে পরিতোষ নিজের হৃদয়ের কথা শোনা বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু নিজের যুক্তির কথা শুনত। সে আসলে কিচ্ছু অনুভব করতে চাইত না। সুখ, দুঃখ - কিছু না। সে শুধু নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখতে চাইত। দোকান বড় করল। চায়ের সঙ্গে সঙ্গে অল্প অল্প মুদির জিনিস রাখা শুরু করল। কেউ বললে বলত, আসলে খরচা বাড়ছে না!

কথাটা খরচা না, কথাটা অনুভব। পরিতোষ শুধু ভাবতে চাইত। অনুভবহীন ভাবনা। গ্যাস ওভেনের মত, টুক করে জ্বাললেই আগুন। মা যেরকম উনুনে আঁচ দিত তেমন না, সে আগুন জ্বলার আগে অনেক ধোঁয়া। সে সব দুর্বল করে মানুষকে। ধোঁয়া মানে আবেগ। অস্পষ্ট। ভালো না।

বাবার চোখের মণি হয়ে গেল জাহ্নবী। ভাগ্যিস বাবা মা আগে চলে গেছেন। মা অবশ্য তেমন নিজেকে জড়াননি জাহ্নবীর সঙ্গে। মা একটু আলগাই থাকতেন। মায়ের বুকের মধ্যে ক্ষোভ জমেছিল অনেক। বংশের কি হবে! মা জাহ্নবীকে আদর করতেন না। জাহ্নবীর সেবা করতেন। খুব করতেন। কিন্তু স্নেহ করতেন কি? মাকে জিজ্ঞাসা করেনি কোনোদিন পরিতোষ। মা জাহ্নবীর প্রসঙ্গ উঠলে কথা ঘুরিয়ে দিতেন। হয় তো মা সহ্য করতে পারতেন না, তাও হতে পারে। মা ভীষণ চাপা মানুষ ছিলেন যে!

 

========= ========== ============ ======

 

দেওয়ালে বাবা মায়ের ছবি পাশাপাশি। জাহ্নবী বোঝেনি তার দাদু তাকে ছেড়ে যে রাতে চলে গেল। সে সেদিন ভীষণ ভায়োলেন্ট ছিল। প্রচণ্ড চীৎকার করেছিল সারারাত। সবাই বিরক্ত হয়েছিল। কে যেন বলেছিল, এ সব ঝঞ্ঝাট ঘরে রাখা যে কি জ্বালা! বাবা বেঁচে থাকলে হয় তো উঠে চড় মারতেন তাকে, কিম্বা হয় তো ঘর থেকে বার করে দিতেন। বা হয় তো কিছুই না করে অন্ধকারে বসে কাঁদতেন।

অন্ধকারে বসে কাঁদতে দেখেছে অনেকবার পরিতোষ বাবাকে। বিশেষ করে তার সেজো পিসির জাহ্নবীকে নিয়ে তামাশা করাটা বাবা মেনে নিতে পারেননি। সেজোপিসি আর এবাড়ি আসেননি কোনোদিন, কিন্তু বাবা কেঁদেছিলেন। সেজোপিসিকে ভীষণ ভালবাসতেন বাবা। কিন্তু কি করবেন, নাতনিকে ওরকম সার্কাসের পশুর মত করে দেখলে বাবার রাগ তো হবেই। পরিতোষের কিন্তু কিছুই হত না। শুধু মাঝে মাঝে মাঝরাতে হঠাৎ করে কেন জানি ভীষণ রাগ হত। বিশেষ কারোর উপর না, এমনিই।

পরিতোষ চুপ করে বসে আছে খাটে। জাহ্নবীর ঘরের রোদ তার পায়ের উপর এসে পড়েছে। তাকের উপর সার দিয়ে রাখা ওষুধের শিশি, প্যাকেট। নেবুলাইজার যন্ত্র। স্যালাইন ঝোলানোর রড। বালিশগুলোর ভাঁজ এখনও মিলিয়ে যায়নি। মাথার বালিশে জাহ্নবীর চুল লেগে একটা। রোদ পড়ে চকচক করছে। গলার কাছে ঘুঁষি মারল কেউ যেন। কাঁদতে বলছে কেউ। কিন্তু কাঁদবে না পরিতোষ। সারা ঘরময় জাহ্নবীর গন্ধ নিয়েও সে কাঁদবে না। শ্মশানের আগুন এত দূর এসে সব পুড়িয়ে যেত যদি! পোড়ায়নি, সব নেয়নি আগুন।

কাঁদলে দোষী হবে পরিতোষ জাহ্নবীর কাছে। হবে না? জাহ্নবীর খাট থেকে পড়ে মাথা ফেটেছে, কাঁদেনি পরিতোষ। তার মাকে খিমচে রক্ত বার করে দিয়েছে, রাখি অসহায়ের মত কাঁদছে, কাঁদেনি পরিতোষ। দাদুর দিকে গ্লাস ছুঁড়ে মেরে দাদুর কপাল ফাটিয়েছে, তাও কাঁদেনি পরিতোষ। আজ কেঁদে কি হবে? কেনই বা কাঁদবে। জাহ্নবী কষ্ট পেলে প্রচণ্ড কাঁদত। বাবাও কাঁদত। পরিতোষ কাঁদত না। টিভির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বসে থাকত। যেন সে টিভি দেখছে না, টিভির থেকে সবাই তাকে দেখছে, আর বলছে, কেঁদো না পরিতোষ, কোথায় থামতে হবে বুঝতে পারবে না। চুপ, চুপ করে থাকো।

 

====== ========= =========== =========

 

রাখি দুটকাপ চা নিয়ে পাশে বসল।

আমরা কি করব এবার?

রাখি সামনের ঝুল বারান্দার দিকে তাকিয়ে বসে। যেন সারারাত একা ঝড়ের মধ্যে হেঁটে তার পাশে এসে বসেছে। তার চুল উসকোখুসকো। চোখ লাল। মুখটা ফোলা। নাকটা লাল।

রাখি আবার জিজ্ঞাসা করল, অন্যদিকে তাকিয়ে, আমরা কি করব এখন, হ্যাঁ গো…

পরিতোষ বলল, আমরা সাঁতার শিখব, পাহাড়ে চড়ব, সারা মাঠ আমি তুমি দৌড়ে বেড়াবো, লাফিয়ে লাফিয়ে ছাদে উঠব, নামব, চীৎকার করে গান গাইব, আমি তোমায় বিরক্ত করবে, তুমি আমায় বিরক্ত করবে, আমরা লুকোচুরি খেলব… আমরা…

পরিতোষের চশমা ছিটকে মেঝেতে পড়ল… জাহ্নবীর পাশবালিশে মুখ গুঁজে, এক হাতে রাখির শাড়ির আঁচল খামচে, আরেক হাত খাটে দাপিয়ে দাপিয়ে যে মানুষটা কাঁদছে… পাগলের মত চীৎকার করে কাঁদছে… সে হারিয়ে যাওয়া, পাথর চাপা পরিতোষ…

রাখি পরিতোষের মাথায় হাত বুলাতে বলল, কাঁদো… কাঁদো… বাবা বলে গেছিলেন, ও যেদিন কাঁদবে, ওকে কাঁদতে দিও দিয়ো বউমা… ওকে থামিও না… ওকে কাঁদতে দিও…